বিশ্বে এখনো কমেনি করোনার প্রকোপ। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে শঙ্কা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের মধ্যে গত এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১২০ শতাংশ রোগী বেড়েছে ভারতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশে। এই সময়ে (২৭ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি) দেশে করোনা রোগী শনাক্তের হার ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। এই এক সপ্তাহে বৈশ্বিকভাবে সংক্রমণ বেড়েছে ৭১ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ সাপ্তাহিক পরিস্থিতি প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিক থেকে টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী ছিল। তবে এই অঞ্চলে এখন রোগী আবার বাড়ছে। ২০-২৬ ডিসেম্বরের তুলনায় গত সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৭৮ শতাংশ।
ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে ১০টি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান ও পূর্ব তিমুর।
ডব্লিউএইচওর তথ্য বলছে, ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ২১৩ জন। এর আগের সপ্তাহে রোগী শনাক্ত হয় ২ হাজার ১৭০ জন। দেশে এক সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। একই সময়ে ভারতে লক্ষাধিক রোগী বেড়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী বেড়েছে মালদ্বীপে, ৩১ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় ৮ শতাংশ ও থাইল্যান্ডে ৬ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
গত এক সপ্তাহে বিশ্বে করোনা শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ মানুষের। সবচেয়ে বেশি রোগী বেড়েছে আমেরিকা অঞ্চলে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী বেড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ইউরোপে রোগী বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। তবে একই সময়ে মৃত্যু কমেছে ১০ শতাংশ। শুধু আফ্রিকা অঞ্চলে ২২ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে।
করোনায় বিধ্বস্ত ভারত
এদিকে ভারতে আবারও বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শুক্রবার নতুনভাবে আরও ১ লাখ ১৭ হাজার ১০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে যা আগের দিনের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি।
করোনায় একদিনে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যাও ৩০২ জনে দাঁড়িয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা হয়েছে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৭৮ জনে।
এরই মধ্যে ভারতের ২৩টি রাজ্য ও ইউনিয়নে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭ জনে।
শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
এর আগে বৃহস্পতিবার ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছিল ৯০ হাজার ৯২৮ মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩২৫ জন।
এদিকে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের সাপ্তাহিক জার্নাল ‘সায়েন্স’ এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১ জুন ২০২০ থেকে ১ জুলাই ২০২১-এর মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভারতে মৃত্যু হয়েছে ৩২ লাখ মানুষের।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের মধ্যে গত এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১২০ শতাংশ রোগী বেড়েছে ভারতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশে। এই সময়ে (২৭ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি) দেশে করোনা রোগী শনাক্তের হার ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। এই এক সপ্তাহে বৈশ্বিকভাবে সংক্রমণ বেড়েছে ৭১ শতাংশ।
এছাড়াও গবেষণাপত্রটিতে দেখা যায়, ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত সরকারি মৃত্যুর হিসেবের থেকে ৬-৭ গুণ বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ পর্যন্ত ভারতে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৪ লাখ ৮০ হাজারেও বেশি। দেশটির জনসংখ্যার প্রতি মিলিয়নে মারা গেছেন ৩৪৫ জন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মিলিয়ন মৃত্যুহারের ৭ ভাগের ১ ভাগ।
দেশব্যাপী ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৮৯ জনের ফোনালাপে নেয়া সাক্ষাৎকার, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা থেকে পাওয়া ২ লাখ মৃত্যুর সনদ, করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হওয়া ১০টি রাজ্যের সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত মৃতের তথ্যের ভিত্তিতে করা গবেষণায় ৩২ লাখের মৃত্যুর বিষয়টি বোঝা যায়।
১৩ মাসে (১ জুন ২০২০ থেকে ১ জুলাই ২০২১) ৩২ লাখের মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে প্রায় ২৭ লাখের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে গত বছর (২০২১) এপ্রিল থেকে জুনে।
করোনাভাইরাসের মৃত্যুর ঘটনার বেশির ভাগই হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই করোনার মৃত্যু সনদ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলে নথিভুক্তির ক্ষেত্রে হেরফের হয়েছে। পাশাপাশি গ্রাম্য এলাকায় অনেকেই মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। তাই তাদেরও নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
সংকটে বাংলাদেশ
দেশে করোনায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বাড়ছে প্রতিদিন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ১৪৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। একই সময়ে করোনায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২০ হাজার ২০৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৬৭। এর আগে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি ছিল গত ২০ সেপ্টেম্বর (৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ)।
করোনার ডেলটা ধরনের দাপটে গত বছরের মাঝামাঝি দেশে করোনায় মৃত্যু, রোগী শনাক্ত ও শনাক্তের হার বেড়েছিল। তবে আগস্টে দেশব্যাপী করোনার গণটিকা দেওয়ার পর সংক্রমণ কমতে থাকে। গত ডিসেম্বরের প্রথম কয়েক সপ্তাহ শনাক্ত ১ শতাংশের ঘরেই ছিল। কিছুদিন ধরে সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সংক্রমণের এই বৃদ্ধি করোনাভাইরাসের অতিসংক্রমক ওমিক্রন ধরনের কারণে, নাকি অন্য কারণ আছে, তা এখনো স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না।
কয়েক দিন ধরে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীদের বড় অংশ ঢাকা জেলার। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মোট শনাক্ত রোগীর ৭৯ শতাংশই এই জেলার বাসিন্দা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনের গুচ্ছ সংক্রমণ হয়েছে ঢাকায়। এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সারা দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না।
বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৩০ কোটি ছাড়িয়েছে
করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার প্রায় দুই বছর পর এর সংক্রমণ ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেল। করোনার সার্বক্ষণিক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুসারে, গতকাল শুক্রবার এই ভাইরাস সংক্রমণ ৩০ কোটি ৩৬ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
এর মধ্যে প্রথম ১০ কোটি আক্রান্ত হয়েছেন এক বছরের বেশি সময়ে। দ্বিতীয় ১০ কোটি আক্রান্ত হয়েছেন তার অর্ধেক সময়ে। আর তৃতীয় ১০ কোটি আক্রান্ত হয়েছেন আরো দ্রুততম সময়ে। এই সময় প্রায় ৫ মাস। ফলে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার কি দ্রুতগতিতে হচ্ছে তা এই পরিসংখ্যান বলে দেয়। আক্রান্তদের বেশির ভাগ রয়েছেন ধনী এবং গরিব দেশের। তারা টিকা নেননি।
সঙ্গে যোগ হয়েছে অধিক সংক্রমণশীল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। এমনকি টিকা নেয়া অনেককেও করোনাভাইরাস নতুন করে আক্রান্ত করছে।
জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বলা হয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে অনেক বিশেষজ্ঞ আক্রান্তের সংখ্যার দিকে দৃষ্টি দেয়া বন্ধ করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন বেশি সংক্রামক মনে হলেও তা কম ক্ষতিকর। এর আগের ভ্যারিয়েন্ট, বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে ভয়াবহ আক্রান্ত করে ওমিক্রন তত নয়। এখনও গবেষকরা বলছেন, টিকা নেয়ার মাধ্যমেই ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি দ্রুত সংক্রমণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং অন্য কিছু দেশে। তবে সেখানে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে ধীরে। তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভয়াবহ এই অবস্থা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আগের সংক্রমণে যে ঢেউ সৃষ্টি হয়েছিল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর যে চাপ পড়েছিল, তা আরো বেড়েছে।
ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়ানো শুরুর পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ করেছেন। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী বলছেন, ধরনটি অন্য ধরনগুলোর তুলনায় কম প্রাণঘাতী। কিন্তু এর সংক্রমণ অন্য যেকোনো ধরনের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়। সেই প্রমাণ ইতিমধ্যে অবশ্য পাওয়া গেছে। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল প্রায় সাড়ে আট লাখ। ভারতে সংক্রমণ ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার। যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ও ফ্রান্সে সংক্রমণ ৩ লাখ ২৮ হাজার। ইউরোপজুড়ে করোনা সংক্রমণের নতুন রেকর্ড হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ