ইতালির উত্তর সিসিলিতে ভূগর্ভস্থ কবরখানায় রয়েছে হাজার হাজার মমি ও কঙ্কাল। কথা ছিল ওই কবরখানায় প্রাপ্তবয়স্কদের কবর দেওয়া ও মমি করে রাখার। কিন্ত এতে পাওয়া গেছে ১৬৩টি শিশুর মমি। খবর আনন্দবাজার
প্রশ্ন হলো, ওই শিশুদের দেহ কেন সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল? এই রহস্যের সমাধান করতে চান গবেষকেরা। ইতোমধ্যে সিসিলির রাজধানী শহর পালেরমোয় কাপুচিন কাতাকোম্বস মঠের কবরখানাটি বিশ্বের বহু গবেষকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।
ইতালির উত্তর সিসিলিতে ওই কবরখানাটি ইউরোপ তথা বিশ্বের বহু গবেষকেরই মনে কৌতূহল জাগাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (১,২৮৪টি) মমি ও কঙ্কাল রয়েছে ওই কবরখানায়। তাদের মধ্যে ষোড়শো শতকের শেষ ভাগে অনেক মমি সংরক্ষণ করা হয়েছিল। কতগুলি আবার বিংশ শতকের গোড়ার দিকের বলেও জানিয়েছেন গবেষকেরা। ইউরোপের পাশাপাশি একে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মমির সংগ্রহও বলে মনে করেন বহু বিশেষজ্ঞ।
সিসিলির রাজধানী শহর পালেরমোয় কাপুচিন কাতাকোম্বস মঠের কবরখানাটি মূলত সেখানকার ধর্মযাজকদের দেহ কবর দেওয়ার জন্য গড়া হয়েছিল। তবে ১৫৯৭ সাল নাগাদ তাতে কবর দেওয়ার জায়গা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে মঠের ভিতরেই আরও একটি ভূগর্ভস্থ কবরখানা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তারা। মূল কবরখানার পিছনে আরও অনেকটা জায়গা জুড়ে তা গড়ে উঠেছিল।
কবরখানার সবচেয়ে পুরনো অংশে রাখা হয়েছিল ধর্মযাজকদের দেহ। একটি হলঘরে পুরোহিতদের সমাধি দেওয়া হত। আর একটি করিডরে মহিলাদের কারুকাজ করা পোশাক ও গয়না পরিয়ে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পুরুষদের জন্য বরাদ্দ একটি করিডরে পালেরমোর অভিজাত পরিবারের সদস্যদের দেহ রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া, শিশুদের সমাধির জন্যও কবরখানায় একটি অংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল।
সিসিলির ওই কবরখানায় শিশুদের মমি পরীক্ষা করবেন এক দল ব্রিটিশ গবেষক। দলের নেতৃত্বে থাকবেন স্ট্যাফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কার্স্টি স্কুইরেস। তিনি জানিয়েছেন, এক্স-রে পদ্ধতির মাধ্যমে বছর দুয়েক ধরে মমিগুলিকে পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ চলবে।
সিসিলির কবরখানায় ওই শিশুদের মমি নিয়ে বিশেষ কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্কুইরেস। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে একাধিক প্রশ্নও উঠছে। স্কুইরেস বলেন, ‘মঠের কবরখানায় শিশুদের দেহ কেন সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল? কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল? কোন সময়ে মারা গিয়েছিল ওই শিশুরা? সে সম্পর্কে আমাদের কাছে প্রায় কিছুই তথ্য নেই। সমীক্ষায় সে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফাঁক ভরাট করার চেষ্টা করব’।
দু’বছরের মধ্যেই সিসিলির ওই মঠে একটি নতুন কবরখানা গড়ে উঠেছিল। যদিও নির্মাণকাজের জন্য পুরনো কবর খোঁড়ার সময় ৪৫টি এমন মমি উদ্ধার হয়, যেগুলি প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, দীর্ঘ দিনের পুরনো হলেও তা পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় ছিল। এমনকি, দেহগুলিতে পচন পর্যন্তও ধরেনি। এতে ‘ঈশ্বরের হাত’ রয়েছে বলেই মনে করতেন মঠের যাজকেরা। সেই মমিগুলি তুলে নিয়ে গিয়ে তারা একটি প্রদর্শনী করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।
৪৫টি মমির প্রদর্শনীর জন্য নতুন কবরখানায় বেশ কয়েকটি করিডর তৈরি করা হয়। তা দিয়েই যাওয়া যেত একটি সংগ্রহশালায়। ধীরে ধীরে সে সংগ্রহশালার বেশ নামডাক হয়। ‘মৃতদের জাদুঘর’ হিসেবেই লোকমুখে পরিচিতি পায় সে সংগ্রহশালাটি।
ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (১,২৮৪টি) মমি ও কঙ্কাল রয়েছে ওই কবরখানায়। তাদের মধ্যে ষোড়শো শতকের শেষ ভাগে অনেক মমি সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
সিসিলির মঠের কবরখানায় শিশুদের কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ১৭৮৭ সাল থেকে। এমনই জানিয়েছেন গবেষকরা। সংবাদমাধ্যমের কাছে স্কুইরেস জানিয়েছেন, কবরখানায় রাখা প্রাপ্তবয়স্কদের মমি ও কঙ্কাল নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়েছে। তবে নাবালক-নাবালিকাদের মমি নিয়ে বিশেষ মাথাঘামানো হয়নি। মূলত পূর্ণবয়স্কদের জন্য সংরক্ষিত হলেও কেন ওই মঠে শিশুদের দেহ মমি করে রাখা হয়েছিল? জানতে চান স্কুইরেস।
‘মৃতদের জাদুঘর’-এ যে শিশুদের মমি রয়েছে, জীবিত অবস্থায় তাদের শরীরস্বাস্থ্য কেমন ছিল? বেড়ে ওঠার বিষয়ে তথ্য বা নামপরিচয় নিয়েও বিশেষ কিছু প্রকাশ্যে আসেনি বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। স্কুইরেসের দাবি, আগামী দু’বছর ধরে এ সমস্ত তথ্য জানার চেষ্টা করবেন তারা। যদিও গবেষণার আগেই তাঁর ধারণা, ওই শিশুরা অভিজাত পরিবারের সদস্য। যদিও কিসের ভিত্তিতে তিনি এ দাবি করছেন, তা নিয়ে বিশেষ কিছু খোলসা করেননি স্কুইরেস।
কীভাবে শিশুদের মমি পরীক্ষা করা হবে, সে বিষয়েও আলোকপাত করেছেন স্কুইরেস। তিনি জানিয়েছেন, ময়নাতদন্ত বা কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে অন্য ভাবে মমিগুলির দেহাংশ বিশ্লেষণ করা হবে। মোট ৫৭৪টি রেডিয়োগ্রাফের মাধ্যমে প্রতিটি মমির ডিজিটাল ইমেজ তোলা হবে। একেবারে পায়ের আঙুল থেকে মাথা পর্যন্ত। এ ভাবে ১৬৩টি মমির মধ্যে ঊনবিংশ শতকের ৪১টি শিশুর মমির পরীক্ষা করা হবে।
কিন্তু কেন ওই শিশুদের পরীক্ষা করা হবে? বয়স্কদের পাশে শিশুদের মমি কীভাবে এল? তা জানার পাশাপাশি ওই শিশুদের মৃত্যু পরিবেশগত কি না, তা-ও খুঁজবেন গবেষকরা। সে জন্য পালেরমোর অন্য জায়গার কবরখানার সমাধিস্থ শিশুদের দেহও পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্কুইরেস।
এর আগে ১৯৯৯ সালে আন্দিজ পর্বতের মাথায় লুলাইলাকো থেকে মাটি খুঁড়ে বের করা হয় একটি মমি। এরপর আরও খুঁড়ে দেখা মেলে একটি নয়, একসঙ্গে তিনটি মমি। তিন জনেরই বয়স খুব কম। মৃত্যুর সময় সবচেয়ে বড় জনের বয়স ছিল ১৩ বছর। বাকি দু’জনের যথাক্রমে চার এবং পাঁচ।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, লুলাইলাকোর ওই তিন মমিই আসলে নরবলির নিদর্শন। তাদের মধ্যে ১৩ বছরের নাবালিকাকে ‘লুলাইলাকো কুমারী’ নাম দেওয়া হয়। তাকেই মূলত ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল। বাকি দু’জনকে রাখা হয়েছিল তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।
বন্দি অবস্থায় দুর্গম ওই স্থানে একটু একটু করে শক্তি হারাচ্ছিল তাদের শরীর। বসে থাকা অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে তারা। ওই অবস্থাতেই মৃতপ্রায় শিশুদের মাটির পাঁচ ফুট নীচে কফিনবন্দি করা হয়েছিল নরবলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৬
আপনার মতামত জানানঃ