মাইক্রোসফট, গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক; বিশ্বের বড় বড় সব প্রযুক্তি কোম্পানিই ‘মেটাভার্স’ তৈরির দৌড়ে নেমেছে। মেটাভার্স একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জগত যার উদ্দেশ্য ইন্টারনেটকে প্রাণ দেওয়া।
অক্টোবরে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ বলেন, তিনি মেটাভার্সে এতটাই বিশ্বাস করেন যে এই খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন বিনিয়োগ করবেন তিনি। জাকারবার্গ নিজের কোম্পানির নামই পরিবর্তন করে রেখেছেন ‘মেটা’। তবে এই মেটাভার্সেই যৌনতা, হয়রানি ও অনাহূত আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারীরা।
মেটাভার্স নিয়ে অভিযোগ
এই বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মেটাভার্স নির্মাণের চিন্তাতে বুদ হয়ে থাকলেও এই কল্পিত জগতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ইতোমধ্যেই।
গবেষকরা বলছেন, মেটাভার্সে থাকা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমগুলো হামলা, হেনস্তা, গুণ্ডামি এবং ঘৃণাত্মক কথাবার্তায় ছেয়ে গেছে। আর এসব দুর্ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগও বেশ সীমিত, প্রতিকার তো নেই বললেই চলে।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, জনপ্রিয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেম, ভিআরচ্যাটে প্রতি সাত মিনিটে একটি নীতিবিরুদ্ধ ঘটনা ঘটে।
আজকের অনলাইন হয়রানি এবং নিপীড়নের চেয়ে মেটাভার্সের দুর্ব্যবহার অনেক বেশি গুরুতর হতে পারে। কারণ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মানুষের পুরো সত্ত্বাকে একটি ডিজিটাল পরিবেশে নিমজ্জিত করে।
যার ফলে ডিজিটাল জগতের যেকোনো অবাঞ্ছিত স্পর্শ আপনার কাছে বাস্তবের মতোই লাগবে।
গেমিং এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে বাজে আচরণ নতুন না। কিন্তু মেটা এবং অন্যান্য বড় কোম্পানিগুলো যেহেতু মেটাভার্সকে তাদের ভবিষ্যতের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড় করাতে যাচ্ছে, সেখানে কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণে এই সমস্যাগুলো নিঃসন্দেহে আরও বড় আকার ধারণ করবে।
জাকারবার্গ যদিও দাবি করেছেন মেটাভার্সের অন্ধকার দিকগুলোর ব্যাপারে তিনি ভালোই সচেতন, এবং মানুষের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই জগতকে তৈরি করবেন তিনি। কিন্তু তার নিজের সহযোগীরাই বলছেন, এই ভার্চুয়াল জগতে কীভাবে মানুষের বিষাক্ত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই তাদের।
গত মার্চে মেটার নির্বাহী সদস্য ও ভবিষ্যৎ প্রধান টেকনোলজি অফিসার অ্যান্ড্রু বসওয়ার্থ এক কর্মচারী মেমোতে লিখেন, মেটাভার্সে মানুষ কী বলবে এবং করবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কার্যতভাবে অসম্ভব।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে কারো দুর্ব্যবহার শনাক্ত করাটা বেশ কঠিন। কেননা, এখানে সবকিছু বাস্তব সময়েই ঘটে এবং ঘটনাগুলো সাধারণত রেকর্ড করা হয় না।
সোফিয়ার অভিজ্ঞতা
গেম খেলার জন্য কিছুদিন আগে সোফিয়া একটি ভিআর হেডসেট কেনেন। সেটি পরে নিজের প্রিয় গেম পপুলেশন ওয়ান খেলতে দিয়ে খুবই ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার।
গেমে একটি লবিতে নিজের ভার্চুয়াল অবতার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সোফিয়া। এই অপেক্ষার মাঝেই অন্য একজন খেলোয়াড়ের অবতার এসে দাঁড়ায় তার সামনে। কোনো বাক্যবিনিময় না করেই সে ব্যক্তি তার অবতারের গায়ে হাত দেয়, এমনকি গায়ে বীর্যপাত করা শুরু করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক সোফিয়া সেই ব্যক্তিকে (এবং তার অবতারকে) থামতে অনুরোধ করেন। ২৯ বছর বয়সী সোফিয়া জানান, কিন্তু সে কিছু না বলে শুধু ঘাড় ঝাঁকায়, যেন সে বলতে চাইছে, ‘এটা মেটাভার্স, এখানে যা করতে মন চায় করবো আমি।
সোফিয়া জানান, শেষ পর্যন্ত গেমের মধ্যে একটি ফর্মে যে ব্যক্তি তাকে হয়রানি করেছিল তার অ্যাকাউন্টের বিষয়ে রিপোর্ট করেছিলেন তিনি। রিপোর্ট করার পর গেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে জানানো হয়, ওই ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি জানি না তাকে একদিনের জন্য বা এক সপ্তাহের জন্য বা আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু শাস্তি যাই হোক না কেন, এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে।
তিনি জানান, প্রথম যৌন নিপীড়নের ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে আবার একইভাবে তার অবতারের উপর নিপীড়ন চালায় আরেকজন।
পপুলেশন ওয়ান খেলতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর সোফিয়া নারীদের একটি ভার্চুয়াল সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেন। গেমারদের এই সাপোর্ট গ্রুপের সদস্যরা জানান, তারাও নিয়মিত হয়রানির শিকার হন।
ম্যারি ডিগ্রাজিয়ার অভিজ্ঞতা
সাপোর্ট গ্রুপের আরেক সদস্য, ম্যারি ডিগ্রাজিয়া (৪৮) বলেন, সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিনবার পপুলেশন ওয়ানে হয়রানি ও হামলার ঘটনা দেখেন তিনি। তিনি বলেন, কখনও কখনও দিনে দুই থেকে তিনবার এসব কর্মকাণ্ড দেখতে হয় আমাদের।
ম্যারি জানান, পপুলেশন ওয়ান গেম কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তিনি। এবং তারা সেসব অভিযোগে সাড়া দিয়ে গেমটিকে আরও নিরাপদ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তাকে।
ম্যারি বলেন, তিনি ভার্চুয়াল বন্ধুদের একটি সম্প্রদায় খুঁজে পেয়েছেন যাদের সাথে এখন নিয়মিত গেমটি খেলেন। শত হয়রানি সত্ত্বেও গেম খেলা ছেড়ে দিতে চান না তিনি।
আমি খেলা বন্ধ করে দিব না। কারণ আমি মনে করি, এই গেমে নারীসহ বিভিন্ন ঘরানার মানুষের অংশগ্রহণ করাটা জরুরী। তারা আমাদের ঠেলে বের করে দিতে পারবে না। যদিও মাঝে মাঝে থেকে যাওয়াটা খুবই কঠিন মনে হয়।
গত জুলাইয়ে একটি হ্যাপটিক ভেস্ট কিনেন ম্যারি। এই ভেস্ট কম্পনের মাধ্যমে আমাদের শরীরে সংবেদন ছড়িয়ে দেয়, যা প্রায় বাস্তবের মতোই। ভেস্ট পরে পপুলেশন ওয়ান খেলতে গিয়ে ম্যারিও সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। আরেকজন খেলোয়াড় তার অবতারের বুক চেপে ধরেন।
ম্যারি বলেন, জাকারবার্গ এমন এক মেটাভার্সের বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে মানুষের পুরো শরীরেই সংবেদনশীল বডি স্যুট লাগানো থাকবে, যা বাস্তবের মতো অনুভূতি দিবে। সেই জগতের চিন্তাটাই আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪০
আপনার মতামত জানানঃ