১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট; কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর সেমিপালাতিনস্ক, বর্তমান সেমেইয়ের বাসিন্দারা হঠাৎ তীব্র ভূমিকম্পের সাথে বিকট এক আওয়াজ শুনতে পায়। মূহুর্তে পশ্চিমাকাশে তারা দেখে দৈত্যাকার মাশরুমসদৃশ এক মেঘ। অন্যদিকে, স্থানীয় বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে একে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমারোহ বলে প্রচার করা হয়। একইসাথে শহরবাসীকে বাড়ির বাইরে বের হয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আহ্বান করা হয়।
অবশ্যই সম্প্রচারটি ছিল মিথ্যা এবং সোভিয়েত সরকারের চাটুকারিতায় ভরা। তবে ঐ মিথ্যার অন্তরালে যে সত্য লুকায়িত ছিল তা পরবর্তী দিনগুলো থেকে আজ পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কাজাখদের নিকট দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে।
সেই ঘটনার চার বছর পূর্বে, ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে একদল পরমাণুবিজ্ঞানী পরীক্ষামূলকভাবে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। ঐদিন পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন এক যুগের সূচনা হয়। পরবর্তীতে পৃথিবীব্যাপী এখন পর্যন্ত যতগুলো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, এর মধ্যে দুটি ব্যতীত সবগুলোই ছিল পরীক্ষামূলক।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (প্রায় এক-চতুর্থাংশ) বিস্ফোরণ ঘটানো হয় কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটে। স্নায়ুযুদ্ধের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিক শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তবে অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রের আশেপাশে অবস্থানরত জনগণের ক্ষতি বরাবরই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট সোভিয়েতদের বিশ্বে সামরিক পরাশক্তি হিসেবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সফলতার চরম মূল্য দিতে হয়েছে কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাসিন্দাদের। সেই সময়ের সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের পক্ষে কাজাখাস্তানের এই নির্মম প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সাথে জড়িত ছিলেন লাভরেন্তি বেরিয়া। বেরিয়া ক্রেমলিনে রিপোর্ট পাঠান- পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত এলাকা ও এর আশপাশ একেবারেই জনমানবশূন্য।
কিন্তু তিনি মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কারণ ঐ পরীক্ষাকেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় কাজাখস্তানের স্তেপে বিচরণ করা যাযাবরদের বেশ কয়েকটি গ্রাম ছিল। এছাড়া সেমিপালাতিনস্ক শহর, যার নামানুসারে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটের নামকরণ করা হয়, উক্ত পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
আর ঐ শহরে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করত। হয় সোভিয়েত সরকার ঐ এলাকাবাসীদের ব্যাপারে ভ্রক্ষেপ করেনি অথবা মানবদেহে বোমার প্রভাব পরীক্ষার অসৎ উদ্দেশ্যে তাদেরকে সেখান থেকে স্থানান্তর করেনি।
সেমিপালাতিনস্ক শহরের বাসিন্দা ভ্যালেন্টিনা নিকনচিকের এখনো মনে পড়ে ১৯৫৩ সালের ১২ আগস্টের কথা। সেদিন তিনি বাড়ির বাইরের মাঠে খেলা করছিলেন, ঠিক তখনই এক গগনবিদারী শব্দ তার কানে আসে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ছোট্ট ভ্যালেন্টিনার হিতাহিতজ্ঞান শূন্যকারী ঐ শব্দের উৎপত্তিস্থল ছিল সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট।
তবে পলিগনে সেদিন বিস্ফোরিত বোমাটি আসলে কোনো সাধারণ পারমাণবিক বোমা ছিল না। বরং সেটি ছিল সোভিয়েত পরমাণু বিজ্ঞানীদের হাতে বিস্ফোরিত প্রথম তাপীয়-পারমাণবিক বোমা, যা ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের। ৪০০ কিলোটনেরও বেশি টিনটির সমতুল্য সেই বোমা হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত ‘লিটল বয়’ থেকে প্রায় ২৫ গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। ক্ষমতার পাশাপাশি মানবদেহে এই বোমার তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকারক প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা যে শুধু নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই ছড়ায় এমনটি নয়। বরং বাতাসের মাধ্যমেও সেই তেজস্ক্রিয়তা দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে যেতে পারে। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৫৬ সালের আগস্টে যখন বিস্ফোরিত বোমার বিষক্রিয়া পলিগন থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উস্ট-কামেনোগর্স্ক শহর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
সেদিন ঐ শহরের প্রায় ৬০০ জন বাসিন্দাকে তেজস্ক্রিয়তাজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি হয়। তবে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য সোভিয়েত সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি। এমনকি পরবর্তীতে ঐ বিষয়ে যত নথিপত্র ছিল তা সোভিয়েতরা হয় নষ্ট করেছে, নাহয় মস্কো নিয়ে গেছে।
দ্রুত ক্রমবর্ধমান কোষের উপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। যেমন ধরুন, মাতৃগর্ভের ভ্রুণ। পলিগনের আশেপাশের গর্ভবতী মায়েদের মাঝে যারা তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসেছিল তাদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিংবা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এমনকি তাদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের পরিমাণও আশংকাজনক। তবে গর্ভবতী মাসহ অন্য যারা তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসেছিল তাদের অনেকের ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তৎক্ষণাৎ দেখা যায় না।
সোভিয়েত সরকার কাজাখস্তানে পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল ঠিকই। কিন্তু তাদের অসুস্থতার আসল কারণ কখনোই তাদের জানানো হয়নি। বরং বলা হয়েছিল, কোনো এক গবাদিপশুর রোগের জন্য তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইটের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসরত কাজাখদের অন্যত্র স্থানান্তরের বদলে সোভিয়েত সরকার পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা তাদের শরীরকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে তারা বেশি আগ্রহী ছিল। সত্যি বলতে, সোভিয়েত পারমাণবিক প্রকল্প যখন লাভরেন্তি বেরিয়ার মতো নরপিশাচের অধীনে, তখন মানুষের শরীরে বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পরীক্ষা করা কোনো অবাস্তব কল্পনা নয়।
পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে পলিগনের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সহজে অনুমেয়। কিন্তু সোভিয়েত সরকার ঐ বোমার নেশায় এতটাই বুঁদ হয়ে ছিল যে তারা তা দিয়ে সরাসরি প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরই পরীক্ষা চালিয়েছে।
খনিজ সম্পদ উত্তোলন, খাল ও জলাধার খনন, বাঁধ নির্মাণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে সোভিয়েতরা ১৯৬৫-৮৮ সাল পর্যন্ত মোট ১২৪টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চাগান হ্রদ খনন প্রক্রিয়া। পারমাণবিক হ্রদ নামেও পরিচিত ঐ জলাধারটি ১৯৬৫ সালের ১৫ জানুয়ারিতে ইরতিশ নদীর অববাহিকায় ১৭৮ মিটার মাটির নিচে স্থাপিত বোমার বিস্ফোরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। ১০০ মিটার গভীর এই হ্রদ প্রস্থের দিক দিয়ে ৪০০ মিটার। পরবর্তীতে খাল খনন করে ইরতিশ নদীর সাথে এর সংযোগ স্থাপন করা হয়।
পারমাণবিক হৃদ নিয়ে সোভিয়েত সরকার বেশ গর্বিত ছিল। কিন্তু আসলে এটা ছিল তাদের অদূরদর্শিতা ও হঠকারিতার পরিচায়ক। কারণ অদ্যবধি ওই হৃদে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একশো গুণ বেশি। এর পানিতে কোনো মাছের উপস্থিতি নেই। এছাড়া পলিগনের অভ্যন্তরে ও এর আশেপাশের এলাকায় প্রায় সর্বত্র অস্বাভাবিক মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা বিদ্যমান।
যদিও গত তিন দশকে প্রকৃতি ঘাস আর লতাপাতা দিয়ে অতীতের ভয়াবহতা অনেকটা ঢেকে দিয়েছে। তবে বারংবার বিস্ফোরিত বোমার আঘাতে সৃষ্ট বৃহদাকার গর্তগুলো কাজাখস্তানের বুকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অপকর্মের ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। তাই দেখে মনেই হয় না এই অঞ্চলটি একসময় সুবিস্তৃত কাজাখ স্তেপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বর্তমানে সেমেই শহরে অবস্থিত আঞ্চলিক মেডিকেল ইনস্টিটিউটে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার স্মরণে মিউটেশন মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে। মাত্র একটি কক্ষ নিয়ে গঠিত সেই যাদুঘরে অস্বাভাবিক আকৃতির ভ্রুণ, শিশুদের বিকৃত মৃতদেহ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের অংশ সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। যেগুলোর আকৃতি ও অবয়ব কোনোভাবেই মানুষের শরীর বলে মনে করা কষ্টসাধ্য।
তবে সেমিপালাতিনস্ক টেস্ট সাইট পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার তিন দশক পূর্ণ হলেও এখনো অঙ্গবিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের মধ্যে অনেকে মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ জমার ফলে সৃষ্ট হাইড্রোসেফালাস রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এর ফলে শরীরের অনুপাতে মাথার আকৃতি কয়েক গুণ বড় হয়ে যায়। এছাড়া অন্যান্য অঙ্গবিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করার নজির অপ্রতুল নয়। অন্যদিকে যারা কোনো ধরনের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি তাদেরও আজীবন ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ