যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটল হিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার এক বছর পূরণ হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি)। এমন প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত দুটি জনমত জরিপে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের ব্যাপারে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ রয়ে গেছে।
সিবিএস নিউজ ও ওয়াশিংটন পোস্ট/ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড পৃথকভাবে জরিপ দুটি চালিয়েছে। গতকাল রোববার জরিপ দুটির ফল প্রকাশ করা হয়। সোমবার (৩ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য সামনে এনেছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন জয়ী হন। পরাজিত হন রিপাবলিকান দলের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নির্বাচনে জালিয়াতির ভুয়া অভিযোগ তুলে ট্রাম্প তার পরাজয় মানতে অস্বীকৃতি জানান। একই সঙ্গে তিনি বাইডেনের জয়ের সত্যায়ন ঠেকাতে নানা তৎপরতা চালান।
বাইডেনের জয়ের সত্যায়নে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বসে। এই প্রক্রিয়া ঠেকাতে ট্রাম্পের উসকানিতে তার উগ্র সমর্থকেরা কংগ্রেস ভবনে (ক্যাপিটল হিল) সহিংস হামলা চালান। ওই দাঙ্গায় পুলিশ সদস্যসহ নিহত হয়েছিলেন ৫ জন।
ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প-সমর্থকদের নজিরবিহীন তাণ্ডবের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের মানুষকে হতবাক করে দেয়। এই হামলাকে মার্কিন গণতন্ত্রের ওপর চরম আঘাত বলে বর্ণনা করা হয়।
২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন বাইডেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ক্ষত সারিয়ে তোলার পাশাপাশি বিভেদ-বিভক্তি দূর করার প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু জরিপে দেখা যাচ্ছে, ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনার এক বছর পরও মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজের পরিচালিত জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান জানিয়েছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের নেতৃত্বে ক্যাপিটল ভবনে হওয়া এই হামলাটি ছিল ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতার একটি বার্তা’। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ‘হুমকির মুখে’।
দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান জানিয়েছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের নেতৃত্বে ক্যাপিটল ভবনে হওয়া এই হামলাটি ছিল ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতার একটি বার্তা’। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ‘হুমকির মুখে’।
এদিকে ওয়াশিংটন পোস্ট-ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের স্পষ্ট পতনের কারণে ‘গর্বিত’ আমেরিকানের সংখ্যাও কমে এসেছে। মার্কিন গণতন্ত্র নিয়ে গর্বিত আমেরিকানের সংখ্যা ২০০২ সালে ৯০ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে তা ঠেকেছে ৫৪ শতাংশে।
সিবিএস নিউজের জরিপে নির্বাচনের ফলাফল রক্ষার জন্য শক্তি ব্যবহার করার পক্ষে ২৮ শতাংশ আমেরিকান মত দিয়েছেন বলে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ওয়াশিংটন পোস্টের জরিপ অনুযায়ী, ৩৪ শতাংশ আমেরিকানের বিশ্বাস—সরকারের বিরুদ্ধে একটি সহিংস পদক্ষেপ মাঝে মাঝে ন্যায়সঙ্গত হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। গত কয়েক দশকের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস পদক্ষেপের পক্ষে মত দিতে দেখা গেল।
দু’টি পৃথক এই জরিপের ফলাফলে কার্যত আমেরিকান সমাজের বিভক্তি এবং অসংলগ্ন দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। যেমন, ক্যাপিটল দাঙ্গার ১৪ দিন পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন জো বাইডেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর ডেমোক্র্যাটিক এই প্রেসিডেন্ট সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে এরপরও ট্রাম্প সমর্থকদের দুই-তৃতীয়াংশ এখনও বিশ্বস করছেন যে, জো বাইডেন বৈধভাবে নির্বাচিত কোনো প্রেসিডেন্ট নন। কারণ ক্যাপিটলে হামলার কিছু সময় আগে হাজার হাজার সমর্থকের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, নির্বাচনের ফলাফলে ‘জালিয়াতি’ হয়েছে এবং এ কারণে তাদেরকে ‘নরকের মতো যুদ্ধ’ করতে হবে।
অবশ্য জরিপে অংশ নেওয়া ৬০ শতাংশ আমেরিকান বলছেন, নির্বাচনে বাইডেনের জয়কে অনুমোদনের সময় ক্যাপিটল ভবনে হওয়া এই হামলার জন্য ট্রাম্পই অনেক বেশি দায়ী। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের জরিপে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেওয়া ৮৩ শতাংশ ভোটার মনে করেন, ক্যাপিটলে হামলায় ট্রাম্পের ‘কিছুটা’ দায় রয়েছে অথবা কোনো দায় নেই।
অন্যদিকে সিবিএসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২৬ শতাংশ আমেরিকান চান ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক।
ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় প্রতিনিধি পরিষদের একটি কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। এই কমিটি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলের কাছ থেকে খুব কমই সহযোগিতা পাচ্ছে। তবে তারা ইতিমধ্যে তিন শতাধিক মানুষের জবানবন্দি নিয়েছে। হাজারো নথি সংগ্রহ করেছে।
রোববার এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্যানেলটির চেয়ারম্যান বেনি থম্পসন বলেন, তদন্তে তারা এমন কিছু বিষয় পেয়েছেন, যা সত্যিকার অর্থেই উদ্বেগের। যেমন—তারা দেখেছেন, মানুষ মার্কিন গণতান্ত্রিক অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে। নির্বাচনের ভিত্তিকে দুর্বল করতে কিছুসংখ্যক মানুষের সমন্বিত তৎপরতা দেখা গেছে।
বর্তমানে ‘গণতান্ত্রিক সংকট’ মোকাবিলা করছে বিশ্ব। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ এমন পরিবেশে বাস করছে যার অধীনে কর্তৃত্ববাদী সরকার রয়েছে। কিন্তু সেখানে বলা হচ্ছে গণতন্ত্র আছে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর ৬৭ শতাংশ মানুষ এমন রাজনৈতিক পরিবেশে বসবাস করছেন যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্র নেই। এশিয়াতেও এমন অনেক দেশ আছে যেগুলো গণতান্ত্রিকও নয়, কর্তৃত্ববাদও নয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪১
আপনার মতামত জানানঃ