এই মহামারিকালীন সময়ে ‘আমার করোনা হবে না’ এমন কথা বলতে শোনা গেছে বহুমানুষকে। গ্রামে করোনা হয় না, বস্তিতে করোনা হয় না, গরিব মানুষের করোনা হয় না এমন নানা থিওরি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেছে এসবই মিথ্যা। বরং এসব অন্ধ বিশ্বাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে মানুষ। তবে এবার এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
বস্তিতে বসবাস করেন না এমন মানুষদের তুলনায় বস্তিতে বসবাসকারীদের শরীরে কোভিড-১৯ এর অ্যান্টিবডি বেশি পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তি সংলগ্ন এলাকার ৬২.২ শতাংশ মানুষ ও বস্তিতে বসবাসকারী ৭১ শতাংশ মানুষ কোভিড-১৯ এর অ্যান্টিবডি বহন করছেন। এরমধ্যে ঢাকায় ৭২.৯ শতাংশ বস্তিবাসী ও চট্টগ্রামের ৫৪.২ শতাংশ বস্তিবাসীর শরীরে কোভিড-১৯ এর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
কোনো ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডি থাকার অর্থ হল, তিনি পূর্বে সংক্রামিত হয়েছিলেন বা ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই তার শরীর রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বস্তি ও বস্তি সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের ওপর জরিপ চালায় আইসিডিডিআরবি।
জরিপকৃত এলাকাগুলোর মধ্যে ঢাকার চারটি বস্তি- কড়াইল, মিরপুর, ধলপুর ও এরশাদ-নগর এবং চট্টগ্রামের দুটি বস্তি শহীদ লেন ও আকবর শাহকাটা পাহাড় রয়েছে।
সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের শরীরে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে। যারা নিয়মিত হাত ধুয়ে থাকেন, মুখে কিংবা নাকে হাত দেন না, বিসিজি টিকা নিয়েছেন এবং মধ্যমানের কায়িক পরিশ্রম করেন এমন ব্যক্তিদের সার্স-কভ-২-তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের শরীরে উল্লেখযোগ্য হারে ভিটামিন ডি-এর অভাব পাওয়া গেছে। কিন্তু ভিটামিন-ডি-এর ঘাটতি অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি।
এছাড়া গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, যারা ডেঙ্গু অথবা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন তারা কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
করোনা সুনামির সতর্কতা
গবেষকদের পর এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে কোভিড সুনামির সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। অতিসংক্রামক ডেল্টা ও ওমিক্রনের দাপটে করোনার সুনামি বয়ে যাবে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
এ অবস্থায় আবারো টিকা প্রদানে সমতা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেবরিয়াসুস। করোনার নতুন ধরন তার সর্বোচ্চ শক্তি দেখাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে বিভিন্ন দেশের ওপর করোনার সুনামি তাণ্ডব শুরু হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গত এক সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী করোনার আক্রান্তের সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম জানান, ডেল্টা ধরনের উপস্থিতিতেই ওমিক্রনের মতো অতি সংক্রামক ধরন বিশ্বজুড়ে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। অতি সংক্রামক এই দুই ধরনের দাপটে সামনে কোভিড সুনামি আসতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন টেড্রোস।
কোভিড সুনামির চাপে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান। ডেল্টা এবং ওমিক্রন রূপান্তর বিশ্বে দ্বৈত হুমকি সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে কোভিড সুনামিতে বিশ্বজুড়ে নতুন কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা রেকর্ড গড়তে পারে বলেও জানান তিনি। হাসপাতালে রোগী ভর্তি এবং মৃত্যুর সংখ্যা, দুইই বাড়ছে বলেও পরিসংখ্যান উল্লেখ করেন এই চিকিৎসক।
টেড্রোস আধানম বলেন, স্বাস্থ্য কর্মীরা গত দুই বছর ধরে মহামারির মোকাবিলা করতে করতে এখন অবসন্ন হয়ে পড়েছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। এই অবস্থায় কোভিড সুনামি বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর অকল্পনীয় চাপ সৃষ্টি করতে চলেছে।
শুধু নতুন করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ বাড়ছে তা নয়, কোভিড-১৯’ এ বিপুল সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এটাও অন্যতম কারণ।
কোভিডে টালমাটাল অবস্থার জন্য টিকার অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন টেড্রোস আধানম গেবরিয়াসুস। মহামারির ইতি টানতে সবার মাঝে টিকা নিশ্চিতে বারবার তাগাদা দিলেও নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলো অধিকাংশ ধনী দেশ।
একদিনে সর্বোচ্চ করোনা রোগী দেখল বিশ্ব
মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) নতুন ধরন ওমিক্রন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নেওয়া হয়েছে জরুরি পদক্ষেপ, বাড়ানো হচ্ছে টিকাকরণের হার। তবুও গত কয়েকদিন দেশে দেশে করোনায় আক্রান্ত অনেক বেড়ে গেছে। মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
বিশ্বব্যাপী করোনার পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বে মারা গেছেন আরও ৭ হাজার ৫৫ জন। অন্যদিকে করোনা শনাক্তের পর এই প্রথম ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৯৯৬ জন।
এর আগে গতকাল বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) আক্রান্ত হয়েছেন ১২ লাখ ১৭ হাজার ৮৩১ জন। মারা গেছেন আরও ৬ হাজার ৫৬৪ জন।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২৮ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ১৪৬ জন এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৭ জনে। আর সুস্থ হয়েছেন ২৫ কোটি ২৪ লাখ ১৪৭ হাজার ৭০৯ জন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ