মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর হামলায় নিজেদের দুজন কর্মীর নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। এর আগে হামলার পর থেকে ওই দুই কর্মী নিখোঁজ ছিলেন বলে জানিয়েছিলো সংস্থাটি।
শুক্রবার মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ প্রদেশে দেশটির সামরিক বাহিনীর একটি হামলায় নিহত ৩৫ জনেরও বেশি মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার করে সেভ দ্য চিলড্রেন। হামলায় নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে। ওই হামলায়ই নিহত হন সেভ দ্য চিলড্রেনের দুই কর্মী। এই হামলা ও প্রাণহানির জন্য সরাসরি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেছে আন্তর্জাতিক এই দাতব্য সংস্থাটি।
দাতব্য সংস্থাটি জানায়, মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কায়া রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর হামলার পর নারী ও শিশুসহ ৩৫টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সৈন্যরা মানুষজনকে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে জোর করে, তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে এবং অন্যদের লাশ পোড়ানোর আগে হত্যা করে বলে দাবি সংস্থাটির।
সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, তাদের নিহত দুই কর্মী সম্প্রতি বাবা হয়েছেন। তারা শিশুদের জন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করতেন। দুজনই ছুটি উপলক্ষে বাড়ি ফিরছিলেন।
এক টুইট বার্তায় দাতব্য সংস্থাটি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও জবাবদিহির জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে পদক্ষেপ নেয়া আহ্বান জানিয়েছে।
কায়াহ রাজ্যের হাপ্রুসো নামক ছোট একটি শহরে সামরিক বাহিনীর ওই হামলার পর প্রকাশ হওয়া ছবিতে পুড়ে যাওয়া যানবাহন যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। জান্তাবিরোধী অন্যতম বৃহৎ গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স বলেছে, নিহত ব্যক্তিরা বিদ্রোহী নয়, বরং সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে চাওয়া বেসামরিক নাগরিক। কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্সের একজন কমান্ডার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘শিশু, নারী, বৃদ্ধ মানুষজনের বিভিন্ন আকারের মরদেহ দেখে আমরা মারাত্মকভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলছেন, ‘শুক্রবার হাপ্রুসোতে সৈন্যরা ‘সন্দেহজনক উপায়ে’ চলা সাতটি গাড়ি থামানোর চেষ্টা করলে লড়াই শুরু হয়।’
হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, সেনাবাহিনীকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানান।
মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কায়া রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর হামলার পর নারী ও শিশুসহ ৩৫টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সৈন্যরা মানুষজনকে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে জোর করে, তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে এবং অন্যদের লাশ পোড়ানোর আগে হত্যা করে বলে দাবি সংস্থাটির।
অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর, এর ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকালে মিয়ানমারে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
এর আগেও সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি গ্রামে ১১ জনকে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে দেশটির সেনাদের বিরুদ্ধে।
সাগাইং নামে একটি গ্রামে বর্বর এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুথানের পর সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করে দেশটিতে গড়ে ওঠা মিলিশিয়াদের সাথে ওই গ্রামে এর আগে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গুলি করে শরীরে আগুন দেওয়ার সময়ও কয়েকজন জীবিত ছিলেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে অং সান সু চিকে বন্দি করে সেনাবাহিনী। বিভিন্ন অভিযোগে সু চির বিরুদ্ধে মামলা চলছে এবং এরই মধ্যে দুটি অভিযোগে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদিকে অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কমপক্ষে এক হাজার ৩০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ হাজার ৬০০ জনকে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের পাশাপাশি রয়েছে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
তবে জান্তা সরকারের নির্যাতনের শিকার সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশুরা। গেল দশ মাসে অন্তত ৯৮ শিশু ও ৮৯ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যার এ ঘটনাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে অভিযোগ উঠেছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন জান্তা বিক্ষোভ দমনে প্রথমে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও জলকামানের ব্যবহার অনুমোদন করলেও এক পর্যায়ে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। তারপর থেকেই দেশটিতে বাড়তে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১২
আপনার মতামত জানানঃ