তাজমহল নির্মাণে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের হাত কেটে নেওয়ার একটা মিথ প্রচলিত আছে। তাজমহল নির্মাণে অন্তত ২০,০০০ মানুষের ২২ বছর সময় লেগেছিল। যে কারিগররা তাজমহল নির্মাণে কাজ করেছিলেন, নির্মাণকাজ শেষে তাদের হাত কেটে নেওয়া হয় যেন তারা পরে কখনো অনুরূপ কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারেন। এটাই প্রচলিত মিথ।
এখন প্রশ্ন হলো, আসলেই কি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছিল? নাকি এটি কেবলই একটি আর্বান মিথ বা শহুরে উপকথা? যদি তা-ই হয়, তবে এর শুরুটা হয়েছিল কীভাবে? এ প্রসঙ্গে কথা বলেন ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সৈয়দ ইরফান হাবিব।
তার বক্তব্য, আমি এ কথা বলতে পারি যে এ আখ্যানের না আছে কোনো প্রামাণ্য ভিত্তি, না কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ কোনোদিন এ ধরনের দাবি করেছেন। প্রসঙ্গত বলতে পারি, এই আর্বান মিথটির জন্ম সেই ১৯৬০-র দশকে। লোকমুখে এ কাহিনি শুনেছিলাম আমি। ১৯৭১ সালে রাঁচি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চ’-এর। সেখানেও এ কাহিনিকে আখ্যায়িত করা হয়েছে একটি শহুরে কিংবদন্তী হিসেবে।
ভারতবর্ষে মোঘলদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন মনিমুগ্ধ এস শর্মা। ‘আল্লাহু আকবর: আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য গ্রেট মুঘল ইন টুডে’স ইন্ডিয়া’ নামে ২০১৯ সালে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে তার। তবে এর আগেই, ২০১৭ সালে তিনি ভারতের শীর্ষ সংবাদপত্র দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লেখেন ‘বাস্টিং দ্য তাজ ফেক নিউজ’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ।
উল্লিখিত নিবন্ধে মনিমুগ্ধ লেখেন, “তাজমহল নিয়ে একটি খুবই জনপ্রিয় গল্প আছে, যেটি আগ্রার লোকাল গাইডদের মুখে মুখে ঘোরে। এছাড়া আজকাল অনেক ডানপন্থী ওয়েবসাইটেও দেখা মেলে এই কাহিনির। কাহিনিটি এমন যে, তাজমহলের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার পর শাহজাহান নাকি তার সৈন্যদের নির্দেশ দেন নেতৃস্থানীয় রাজমিস্ত্রিদের হাত কেটে নিতে, যেন তারা পরে কখনোই এই অত্যাশ্চর্য অবকাঠামোর নকল তৈরি করতে না পারেন।
“কিন্তু এই কাহিনি বাস্তবে বিদ্যমান তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি আজও তাজ গঞ্জ নামে একটি বিশাল বসতির অস্তিত্ব রয়েছে। সম্রাট শাহজাহান এই বসতিটি গড়ে তুলেছিলেন তাজমহল নির্মাণে অংশ নেওয়া হাজারো রাজমিস্ত্রি, কারিগর ও অন্যান্য শ্রমিকদের জন্য, যারা তার রাজ্যের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সমবেত হয়েছিলেন। ওই শ্রমিকদের বংশধররা আজও সেখানে বাস করেন, এবং তাদের দাদা-পরদাদাদের শিখিয়ে যাওয়া কাজ করেন।
“তাছাড়া আরো একটি বিষয় হলো, তাজমহল নির্মাণ শেষে শাহজাহানের শ্রমিকরা তার জন্য দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নামে একদমই নতুন একটি সাম্রাজ্যিক শহরও নির্মাণ করেন। যদি তাজমহল নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদেরই তিনি এ কাজে নিযুক্ত না করেন, সেক্ষেত্রে পুনরায় সম্রাটের পক্ষে আবারও এত কম সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ রাজমিস্ত্রি ও কারিগরের দল খুঁজে বের করা ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি।”
২০১৭ সালে ইন্ডিয়া টুডেও তাজমহল নিয়ে একটি বিশেষ লেখা প্রকাশ করে। সেখানে শ্রমিকদের হাত কাটার প্রসঙ্গটিকে উপকথা বা কিংবদন্তি হিসেবে উল্লেখ করে লেখা হয়, বেশিরভাগ ভারতীয়ই ছোটবেলা থেকে এ গল্প শুনে এসেছেন যে তাজমহলের নির্মাণশ্রমিকদের হাত নাকি সম্রাটের আদেশে কেটে নেওয়া হয়েছিল, যেন তারা পরবর্তীতে কখনো এ ধরনের সৃষ্টিকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারেন।
কিন্তু এ মিথটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, কেননা এই তথ্যটিই তো উদঘাটিত হয়েছে যে তাজমহলের প্রধান স্থপতি ওস্তাদ আহমদ লাহৌরিকে পরে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের আরো অনেক অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাজমহলের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও হাত কাটা প্রসঙ্গে কোনো তথ্য নেই। তবে দ্য তাজ ট্যুরস ওয়েবসাইটে এই উপকথাকে কেন্দ্র করে ঊষা নরেশের লেখা একটি ব্লগ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে প্রথমে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে কেন এ উপকথাটির সত্য হওয়া সম্ভব নয়।
প্রথমত, কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ যেমন হাতের কঙ্কাল নেই, যা থেকে বোঝা সম্ভব আসলেই এ ধরনের গণ হাত কর্তনের ঘটনা ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত, সমসাময়িক কোনো গ্রন্থ কিংবা ভারতে তৎকালীন কোনো বিদেশি সফরকারীর আত্মজৈবনিক রচনায়ও এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তৃতীয়ত, শাহজাহানের শাসনামলকে বলা হয় ‘মোঘল নির্মাণের স্বর্ণযুগ’। তার শাসনামলে নির্মাণকাজ কখনোই থামেনি। তিনি আগ্রায় নির্মাণ করেন মোতি মসজিদ ও তাজমহল, দিল্লিতে লাল দুর্গ ও জামা মসজিদ; এছাড়াও স্থাপন করেন শাহজাহানাবাদ নামের একটি শহর। তিনি যদি আসলেই অঙ্গচ্ছেদের ঘটনা ঘটাতেন, তাহলে কোনো শ্রমিকই তার এসব কাজে অংশ নিতেন না।
এরপর ওই ব্লগটিতে একটি হাইপোথিসিসও দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে কীভাবে উপকথাটির আগমন ঘটেছে। বাস্তবে, শাহজাহান তার শ্রমিকদের উপর একটি নৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন যে তারা অন্য কোনো সম্রাটের জন্য কাজ করতে পারবেন না। আধুনিক সময়ে আমরা এটিকে সম্রাট ও তার শ্রমিকদের মধ্যে একটি চুক্তি বলতে পারি। তাই ‘শ্রমিকদের হাত কেটে নেওয়া হয়’ কথাটির মাধ্যমে আসলে বোঝানো হয়েছিল যে ওই শ্রমিকরা অন্য কোনো সম্রাটের কাছ থেকে কাজ নিতে পারবেন না।
একই ধরনের সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায় স্বাধীন গবেষক ও ইতিহাসবিদ শশাঙ্ক শেখর সিনহার ২০২১ সালে প্রকাশিত বই ‘দিল্লি, আগ্রা, ফতেহপুর সিক্রি: মনুমেন্টস, সিটিজ অ্যান্ড কানেক্টেড হিস্ট্রিজ’ বইতেও।
সেখানে তিনি লেখেন, “আরেকটি জনপ্রিয় মিথ হলো এই যে, শাহজাহান তাজমহল নির্মাণকারী স্থপতি ও শ্রমিকদের মেরে ফেলেন। অন্যান্য সংস্করণে শোনা যায়, সম্রাট তাদের হাত কেটে ফেলেন এবং তাদের চোখ খুবলে বের করে নেন, কিংবা তাদেরকে ছুড়ে ফেলেন আগ্রা দুর্গের অন্ধকূপে, যেন আর কেউই অবশিষ্ট না থাকে এ ধরনের দ্বিতীয় কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য।”
“এছাড়া মিথটির কিছু অহিংস সংস্করণও রয়েছে যেখানে বলা হয়, সম্রাট তাদেরকে মোটা অংকের অর্থপুরস্কার দেন এবং একটি চুক্তিপথ লিখিয়ে নেন যেন তারা আর কখনোই এ ধরনের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে না পারে। ভবিষ্যতে কারো কাজের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াও এক অর্থে তার ‘হাত কেটে ফেলা’। এভাবেই অনেক ট্যুরিস্ট গাইড বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন। তারপরও, এ ধরনের কাহিনীরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, এবং এ ধরনের কাহিনি ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নানা স্মৃতিস্মম্ভকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান লোককথায়ও রয়েছে।”
বলাই বাহুল্য, সর্বশেষ দুই হাইপোথিসিস সম্পর্কেও শতভাগ নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব নয়। তবু এ কথাও অনস্বীকার্য যে এসব হাইপোথিসিসকে সত্য বলে মেনে নিলে অনেক বিভ্রান্তিই দূর হয়ে যায়। আপাতত এটুকু বিভ্রান্তি থেকেই আজ বেরিয়ে আসা যাক যে, শাহজাহান কখনো তাজমহলের নির্মাণশ্রমিকদের হাত কেটে নেননি!
এসডব্লিউ/এসএস/২০৫০
আপনার মতামত জানানঃ