কয়েক মাস ধরে জুমার নামাজকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজধানী দিল্লির অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শহরতলী গুরুগ্রামে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। মুসলিমরা বলছেন, তাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মসজিদ নেই। সে জন্য তারা পাবলিক প্লেসে নামাজ পড়তে বাধ্য হচ্ছেন। প্রশাসন যদি জায়গা দেয়, তাহলে তারা খোলা জায়গায় নামাজ পড়বেন না। খবর বিবিসির
হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর একদল লোক শোরগোল করে দাবি করছে যে, খালি জায়গাগুলোয় নামাজ আদায় বন্ধ করতে হবে। খালি জায়গা বলতে তারা মূলত বোঝাচ্ছেন কার পার্ক, কারখানা, বাজার এবং কারখানার কাছে সরকারী মালিকানাধীন প্লট এবং আবাসিক এলাকা— যেখানে শ্রমিক শ্রেণীর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা বছরের পর বছর ধরে নামাজ পড়ে আসছেন।
তারা শ্লোগান দিয়ে বলছেন যে যানবাহন পার্ক করে এবং কড়া ভাষা ব্যবহার করে যেন মুসলমানদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এ সময় তারা মুসলমানদের জিহাদি এবং পাকিস্তানি বলেও সম্বোধন করেন।
বর্তমানে সেখানে পুলিশের নিরাপত্তায় নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।
হরিয়নার গুরুগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বেশ কিছু স্থানে দীর্ঘদিন ধরে জুম্মাবারের নামাজ পড়ে আসছিলেন মুসলিমরা। কিন্তু সেখানে প্রকাশ্যে নামাজ পাঠে বাধা দিতে থাকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের সদস্যরা। নামাজ ভণ্ডুল করতে থাকায় স্থানীয় গুরুগ্রাম প্রশাসন মাত্র ২০টি জায়গায় নামাজের অনুমতি দেয়। কিন্তু তারপরও দেখা যায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নামাজ বরবাদ করে দেওয়া থামছে না। তাদের দাবি, গুরুগ্রামে প্রকাশ্য নামাজ পড়া যাবে না।
উল্লেখ্য, গুরুগ্রামে মসজিদ প্রায় নেই বললে চলে। তাই এই শিল্পতালুকে কর্মরত মুসলিমদের নামাজ পড়তে হয় প্রকাশ্য জায়গাতেই। যদিও তার জন্য প্রশাসনের অনুমতিও নেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো নামাজ বন্ধ করে সক্রিয় হতে থাকে।
গত শুক্রবার হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দরের সুরে সুর মিলিয়ে সাফ জানিয়ে দেন, প্রকাশ্যে খোলা জায়গায় নামাজ পড়া সহ্য করা হবে না গুরুগ্রামে। তার বক্তব্য, প্রকাশ্যে খোলা জায়গায় মুসলমানদের জুমার নামাজ আদায় করা উচিত নয়। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে রাজ্য পুলিশকে নির্দেশও দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী খট্টর বলেন, গুরুগ্রাম প্রশাসন সব পক্ষের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করছে। তার সরকার একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান নিয়ে কাজ করবে, যা কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। তার আগে পর্যন্ত নিজ বাড়িতে কিংবা মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। মসজিদে গিয়ে কেউ প্রার্থনা করলে আমাদের সমস্যা নেই।
স্থানীয় মুসলমানদের একটি কমিউনিটি গ্রুপ গুরুগ্রাম মুসলিম কাউন্সিলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আলতাফ আহমেদ বলেন, পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। আমরা কখনোই চাইনি গুরুগ্রামে এমন হোক।
ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে গুরুগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। মাত্র তিন দশকে এই অঞ্চলের গ্রামগুলো বদলে গেছে। এক সময়ের গ্রামগুলো এখন সেখানকার অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং দ্রুত বর্ধনশীল ব্যবসায়িক শহরে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবাদী হিন্দু গোষ্ঠীর এক নেতা কুলভূষণ ভরদ্বাজ বলেন, আমরা নামাজের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু খোলা জায়গায় নামাজ করা ‘স্থল জিহাদ।’
মুসলমানরা বলছেন যে এটা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আনা অনেক নতুন অভিযোগের মধ্যে একটা। বলা হয় যে মুসলমানরা নামাজের নামে জমি দখলের পরিকল্পনা করছে।
এর আগে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো ‘লাভ জিহাদের’ অভিযোগ তোলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর অভিযোগ, মুসলিম যুবকরা প্রেমের নামে হিন্দু মেয়েদের ফাঁদে ফেলে এবং বিয়ের পর ছেড়ে দেয়। এটাকে হিন্দু গোষ্ঠীগুলো ‘লাভ জিহাদ’ বলে। হিন্দুত্ববাদী দলগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোহত্যার অভিযোগও এনেছে।
আমরা নামাজের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু খোলা জায়গায় নামাজ করা ‘স্থল জিহাদ।’
প্রতিবাদকারী গোষ্ঠীর দাবি যে তারা দুই ডজনেরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন হিন্দু-জাতীয়তাবাদী দলের একটি সংগঠন। এই দলগুলো নামাজের বিষয়টি উত্থাপনের জন্য একটা সম্মিলিত হিন্দু সংগ্রাম সমিতি গঠন করেছে। তারা এখন স্থানীয় জনগণের কাছ থেকেও সমর্থন পাচ্ছে।
সুনীল যাদব নামে এমন একজন তার বাড়ির কাছে ৩৬ একরের একটি খালি প্লটে নামাজ পড়া বন্ধ করতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, মুসলিমরা আমাদের বাড়ির কাছে খোলা জায়গায় নামাজ পড়ে সেটা আমরা পছন্দ করি না। নামাজের পরে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
গত সপ্তাহে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার যখন বলেছিলেন যে রাজ্যে খোলা জায়গায় নামাজের অনুমতি দেওয়া হবে না, তখন এই বিক্ষোভকারীরা উৎসাহ পেয়েছিলেন। মনোহর লাল খট্টর বলেছিলেন, ‘খোলা জায়গায় নামাজ সহ্য করা হবে না। এই রীতি সংঘাতের পথে নিয়ে যায় আর আমরা এই সংঘাত ঘটতে দেবো না।
২০১৮ সাল থেকে খোলা জায়গায় নামাজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। আলোচনার পরে, মুসলিমরা ১০৮টি থেকে খোলা ময়দানের নামাজের জায়গা ৩৭টিতে কমিয়ে আনতে রাজি হয়। তবে এই বছরের বিক্ষোভের কারণ কী তা এখনও স্পষ্ট নয়। সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভের পর মুসলমানরা এখন খোলা জায়গায় নামাজ পড়ার স্থান ২০টিতে কমিয়ে এনেছে।
রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে গবেষণাকারী হিলাস আহমেদ বলেন, এই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো নাগরিক সমস্যাকে ব্যবহার করে ধর্মীয় উম্মাদনা ছড়াচ্ছে। তারা মুসলমানদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বলছে। কিন্তু সমস্যা হলো সেখানে পর্যাপ্ত মসজিদ নেই।
গুরুগ্রামে মাত্র ১৩টি মসজিদ রয়েছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র একটি শহরের নতুন এলাকায় রয়েছে। শহরের বেশিরভাগ অভিবাসী এখানে বসবাস করেন এবং কাজ করেন। মুসলিম সম্পত্তির তত্ত্বাবধানকারী ওয়াকফ বোর্ডের স্থানীয় সদস্য জামালউদ্দিন বলেছেন, বোর্ডের বেশিরভাগ জমি শহরের উপকণ্ঠে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা কম।
তিনি বলছেন যে, এই জাতীয় এলাকার ১৯টি মসজিদ বন্ধ করতে হয়েছিল। কারণ সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক মুসল্লি ছিল না। তারা বলছেন, গুরুগ্রামের দামি এলাকায় জমি কেনার মতো টাকা পর্ষদের কাছে নেই।
গুরুগ্রাম মুসলিম কাউন্সিলের মতে, নগর পরিকল্পনাবিদরা যারা গুরুগ্রাম শহরের পরিকল্পনা করেছিলেন তারা ৪২টি মন্দির এবং ১৮টি গুরুদ্বারের জন্য জায়গা বরাদ্দ করেছিলেন। সেখানে মাত্র একটি মসজিদের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাঁচ বছর আগে দুটি মুসলিম সংগঠন ধর্মীয় উদ্দেশ্যে জমির প্লট কেনার নিলামে অংশ নিলেও প্লট কিনতে পারেনি।
আজ গুরগাঁওয়ে যা ঘটছে সেটা ২০১১ সালে প্যারিসের রাস্তায় নামাজ পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেয়, যা ডানপন্থীদের প্রতিবাদের মুখে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার কারণ ছিল, মুসলমানরা তখন মসজিদে নামাজের জন্য জায়গা পাননি। পরবর্তীতে নামাজের জন্য অব্যবহৃত ব্যারাক ভাড়া দেওয়ার জন্য দুটি স্থানীয় মসজিদের চুক্তি হয়।
গুরুগ্রামে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। মুসলমানদের নামাজ পড়ার জায়গা দিয়েছেন এক হিন্দু ব্যবসায়ী—এমন উদাহরণও রয়েছে। গত মাসেই শিখ গুরুদ্বারগুলো মুসলমানদের নামাজ পড়ার জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে, হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর প্রতিবাদের মুখে গুরুদ্বার তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।
ভারতজুড়ে ধর্ম নিয়ে গবেষণা করা পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষায় উঠে এসেছে— ভারতের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন যে সত্যিকারের ভারতীয় হওয়ার জন্য সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন।
কিন্তু এই মুহূর্তে গুরুগ্রামের মুসলমানরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। শুক্রবার কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার জন্য এবং নামাজ আদায়ের স্থান খুঁজে পেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার জন্য অনেকে বেতন হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন। আহমেদ নামে একজন বলেন, আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি এবং প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৭
আপনার মতামত জানানঃ