সে সময় পোল্যান্ডের দখল নিয়েছে নাৎসি বাহিনী। শুরু হয়েছে ইহুদি হত্যা। অত্যাচার, নির্যাতনের মধ্যেই চলছে ইহুদিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। বাসস্থান কেড়ে নিয়ে তাদের ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। তবে নাৎসিদের এই কর্মকাণ্ড আটকে গিয়েছিল টাইফাসের সংক্রমণে।
পোল্যান্ডের কিছু কিছু অংশে পরিস্থিতি এতটাই ঘোরতর হয়ে উঠেছিল যে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ৭৫০। টাইফাসের আতঙ্কেই কমে গিয়েছিল পুনর্বাসনের গতি। সংক্রমিত এলাকাগুলিতে প্রবেশ করাও বন্ধ করে দিয়েছিল নাৎসিরা।
তবে এই মহামারীকালীন পরিস্থিতিকেই নাৎসিদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করে তুলেছিলেন এক পোলিশ চিকিৎসক। টাইফাস-আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন প্রায় আট হাজার মানুষের। মূলত তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন ‘মিথ্যে’ মহামারী।
পোলিশ এই চিকিৎসকের নাম ইউজিন লাজস্কি। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে আগে পোল্যান্ডের ওয়ারশ-এর জোসেফ পাই সুডস্কি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিক্যাল পাশ করেন ইউজিন। জার্মান অধ্যুষিত পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে রেড ক্রস বিভাগে চাকরিও জুটে যায়। তবে মন পড়ে থাকত রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকেই। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার পোলিশ নাগরিক। আর তাতে যেন বিন্দুমাত্র যায় আসে না জার্মান প্রশাসনের।
ইহুদিদের চিকিৎসা করার ওপরেও কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল নাৎসিদের। অমান্য করলে মৃত্যুদণ্ড। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ওয়ারশ-র রেলস্টেশনে এবং স্থানীয় ইহুদি আবাসস্থলগুলোতে গোপনে ওষুধ সরবরাহ শুরু করেন ইউজিন। সেভাবেই সেনাবাহিনীর বাইরেও স্থানীয়দের মধ্যেও বেশ পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তার।
১৯৩৯ সালের শেষের দিকে, ইউজিন এবং তার সহকর্মী ও সহপাঠী স্তানিস্ল মাতুলেউইকস আবিষ্কার করেন এক চমকপ্রদ পন্থা। টাইফাসের টিকা তৈরি করতে গিয়েই একটি অদ্ভুত ঘটনা নজরে আসে তাদের। মৃত টাইফাস ব্যাসিলাসকে মানবদেহে প্রয়োগ করলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি আক্রান্ত হন না টাইফাসে। তার থেকে সংক্রমণ ছড়ানোরও ভয় থাকে না। তবে ইনজেকশন দেওয়ার প্রায় দু’মাস পরেও তার রক্তপরীক্ষা করলে পজিটিভ আসে টাইফাসের রিপোর্ট।
এই আবিষ্কারই যেন অস্ত্র তুলে দেয় ইউজিনের হাতে। গোপনে শুরু হয় রেজওয়াডোর ইহুদি আবাসস্থলগুলোতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মৃত ব্যাসিলাসের টিকাকরণের কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনিই এই অভিযান চালাতেন ‘নিষিদ্ধ’ অঞ্চলে। উল্টোদিকে স্তানিস্ল ল্যাবরেটরিতে তৈরি করতেন মৃত টাইফাস ব্যাসিলাস। অবশ্য এই কর্মকাণ্ডে ভূমিকা ছিল স্থানীয়দেরও। ইউজিনের নির্দেশ মেনে টাইফাস আক্রান্তদের উপসর্গের মতোই অভিনয় করতে হত তাদের। দ্বারস্থ হতে হত জার্মান কার্যালয়ে। তারপর রক্তপরীক্ষা। পজিটিভ রিপোর্ট। কোয়ারেন্টাইন।
তবে কোয়ারেন্টাইন না বলে, কন্টেনমেন্ট জোন বললেই হয়তো আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সুবিধা হবে সেদিনের অবস্থাটা। একের পর এক টাইফাসের রিপোর্ট এলেই কন্টেনমেন্ট জোন থেকে তড়িঘড়ি সেনা সরিয়ে নিত জার্মানি। বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত সংশ্লিষ্ট লোকালয়টিকে। সেই সুযোগেই চলত ‘পাচার’। গোপনে ইহুদিদের দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেন ইউজিন।
বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে এসে রাশিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েছিলেন ইউজিন। ছাড়া পেলেও নিস্তার মেলেনি। নাৎসি বাহিনীর সঙ্গেই বন্দি হয়েছিলেন তিনি। ফলত, দেশের চোখে ‘শত্রু’ হিসাবেই বিবেচিত হয়েছিলেন ইউজিন। আশ্রয় নিতে হয় আমেরিকায়। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে দেশে ফেরেন তিনি।
প্রকাশিত হয় তার লেখা ‘প্রাইভেট ওয়ার’ নামে একটি আত্মজীবনী। সেই বই প্রকাশের পরই সামনে আসে তার গল্প। ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করতে টেস্টিমোনিয়ালও হয় পোল্যান্ডে। না, দেশ-বিদেশের উপকৃতরা চিনতে ভুল করেননি এই পোলিশ চিকিৎসককে। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে হলোকাস্ট হিরোর সম্মান জোটে তার কপালে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ