যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯-এর নতুন ধরন ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। দেশটিতে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১৩৯। গতকাল দেশটির স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড কিংডম হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি (ইউকেএইচএসএ) এ তথ্য জানিয়েছে। নতুন বিধিনিষেধ আরোপ না করা হলে বা ব্যবস্থা না নিলে যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রকোপ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ ২৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে ইংল্যান্ডে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের (এলএসএইচটিএম) গবেষকরা একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন। এতে সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে তার আভাস দেওয়া হয়েছে। তবে গবেষণার পেছনের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মডেলিংয়ের চারপাশে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাছাড়া এই গবেষণা এখনো পিয়ার রিভিউড হয়নি।
আরও বলা হয়, বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রায় প্রতি আড়াই দিনে দেশটিতে ওমিক্রন রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ডা. নিক ডেভিস জানিয়েছেন, ওমিক্রন খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এটা উদ্বেগজনক। বছরের শেষ নাগাদ এটা করোনার সবচেয়ে ‘ডমিন্যান্ট’ রূপ হতে পারে ইংল্যান্ডে।
যুক্তরাজ্য বলছে, শুক্রবার মোট সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ১৯৪ জনে।
ব্রিটেনের কমিউনিটি সেক্রেটারি মাইকেল গোব বলেন, দেশ মারাত্মক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মুখে। কারণ ওমিক্রন খুব দ্রুতবেগেই ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ সংখ্যা দুই-তিন দিনের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। গত ৯ জানুয়ারির পর আজ করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটেছে। তখন করোনার সংক্রমণ ছিল ৫৯ হাজার ৯৩৭।
তিনি আরো বলেন, লন্ডনে শনাক্ত করোনার সংক্রমণের ৩০ শতাংশই ওমিক্রন ধরনের। অথচ এই ধরন কেবলমাত্র দুসপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়েছে।
দেশটির স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা বলছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী মধ্য ডিসেম্বর নাগাদ ওমিক্রন করোনার নিয়ন্ত্রক ধরন হয়ে উঠবে।
সংস্থাটি আরো বলছে, অ্যাস্ট্রোজেনকা কিংবা ফাইজার ওমিক্রন প্রতিরোধে অল্পই কার্যকর। কিন্তু বুস্টার ডোজ ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইতোমধ্যে কিছু কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন। একে তিনি ‘প্ল্যান বি’ নামে বর্ণনা করেছেন। নতুন ঘোষিত বিধি নিষেধ নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে এবং আগামী সপ্তাহে হাউজ অব কমন্সে ভোটাভুটি হবে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইতোমধ্যেই বলেছেন, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও সংক্রামক হতে পারে ওমিক্রন। একইসঙ্গে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, আগামী জানুয়ারিতেই দেশটিতে বড় আঘাত হানতে পারে ওমিক্রন। ফলে নতুন বছরের শুরুতেই বড় আকারে সংক্রমণের ঢেউ দেখা যেতে পারে। আর এতেই প্রাণ হারাতে পারেন ২৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার মানুষ।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের (এলএসএইচটিএম) বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, চলতি মাসের শেষের দিক থেকেই করোনা আক্রান্তদের সংক্রমিত হওয়ার প্রধান ধরন হয়ে উঠতে পারে ওমিক্রন। আর এতে করে জানুয়ারিতে বড়সড় সংক্রমণের ঢেউ দেখা দিতে পারে যুক্তরাজ্যে।
বিজ্ঞানীদের মতে, সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখলেও ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ চূড়ায় উঠলে দৈনিক হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই হিসেবে ১ ডিসেম্বর থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কম করে হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছাড়াতে পারে পৌনে দুই লাখ এবং প্রাণহানি হতে পারে ২৪ হাজার ৭০০।
অন্যদিকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রে এই গবেষণা অনুসারে, আগামী এপ্রিলের শেষের মধ্যে ভাইরাস আক্রান্ত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। দৈনিক হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের সর্বাধিক সংখ্যার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সুরক্ষা করোনার এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ঠিক কতটা এড়াতে পারছে এবং কার্যকরী বুস্টার ডোজ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী করতে পারবে, তার ওপরই মূলত আক্রান্তের সংখ্যা নির্ভর করবে। ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর এই দু’টি বিষয় এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
দেশ মারাত্মক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মুখে। কারণ ওমিক্রন খুব দ্রুতবেগেই ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ সংখ্যা দুই-তিন দিনের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
সাইন্টিফিক অ্যাডভাইসরি গ্রুপ ফর ইমারজেন্সিস (সেজ) এবং সাইন্টিফিক প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা গ্রুপ অন মডেলিং (এসপিআই-এম) এর অংশ হিসেবে এসব বিজ্ঞানীরা ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরীক্ষামূলক বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে তারা এটিই দেখাতে চেয়েছেন যে, করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ‘প্লান বি’ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ব্রিটেনে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, যে হারে ওমিক্রনে আক্রান্ত বাড়ছে তাতে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে দ্রুতগতিতে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়বে যুক্তরাজ্যে। কেননা দেশটির সর্বত্র দ্রুতহারে বাড়ছে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাস শেষ হওয়ার আগে দেশটিতে প্রাধান্য বিস্তার করবে কোভিডের এ ভ্যারিয়েন্ট।
গত শুক্রবারের পর থেকে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় উল্লম্ফন দেখা গেছে। সেদিন ওমিক্রনে শনাক্ত হয়েছেন ৪৪৪ জন। তাদের মধ্যে একজন স্কটল্যান্ডের, বাকি রোগীরা ইংল্যান্ডের। তবে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে কোনো নতুন রোগী শনাক্ত হননি।
গত ২৪ নভেম্বর প্রথম ওমিক্রনের সংবাদ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার জনস্বাস্থ্য ও জীবাণু বিশেষজ্ঞরা। এর দুই দিনের মাথায়, ২৬ নভেম্বর ওমিক্রনকে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৫৭টি দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
যুক্তরাজ্যে এ পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮ হাজার ১৯৪ জন। মহামারির শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক কোটি ৭১ লাখ ৯ হাজার ১৬৫ জন। দৈনিক ১২০ জন মারা যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত এ রোগে দেশটিতে মারা গেছেন মোট এক লাখ ৪৬ হাজার ২৫৫ জন। এ পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৭৬ দশমিক তিন শতাংশ মানুষ। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৬৯ দশমিক ছয় শতাংশ। তৃতীয় ডোজ নিয়েছেন ৩৩ দশমিক এক শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনে আক্রান্তদের উপসর্গ মৃদু। আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনও পড়ছে না।
করোনার দ্রুত সংক্রমণশীল ধরন ওমিক্রন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কর্ণাটকসহ বিভিন্ন রাজ্যে এ ধরন শনাক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে ভাইরাসের ধরন শনাক্তের কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, জিম্বাবুয়ে থেকে ফিরে আসা জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের দুই ক্রিকেটারের দেহে ওমিক্রনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তাদের তৃতীয় দফা পরীক্ষায়ও ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন নিয়ে আমরা সতর্ক আছি। যারা বিদেশ থেকে আসবে, তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আমাদের বলেছে, যে টিকা আমরা দিচ্ছি, ওমিক্রন প্রতিরোধে তা অনেকটা সক্ষম। তাই সবার টিকা নেয়া উচিত।’
করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার বাড়তি ডোজ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘করোনায় এখন পর্যন্ত মারা যাওয়াদের বেশিরভাগই বয়স্ক। তাই তাদের বুস্টার ডোজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
ওমিক্রন শনাক্ত হওয়া নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যায় দুজনের নমুনা নেয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে।
তিনি জানান, জিনোম সিকোয়েন্সিং করার পর ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিয়মিত তাদের বিষয়টি দেখছেন।
আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের টুর্নামেন্ট শেষে ১ ডিসেম্বর দেশে ফেরে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। দেশে ফিরে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ৫ দিনের কোয়ারেন্টিনে প্রবেশ করেন ক্রিকেটাররা।
আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানা থেকে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ার কারণে টুর্নামেন্টের মাঝপথেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব বাতিল করতে বাধ্য হয় আইসিসি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০১
আপনার মতামত জানানঃ