যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন বাংলাদেশ সরকারের ওপর বড় ধরনের কূটনৈতিক চাপ তৈরি হল। র্যাব প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরে বিভিন্ন সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুমের অনেক ঘটনা বাহিনীটিকে বিতর্কে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ বলছে অন্তত ছয়শ মানুষকে গুমের অভিযোগ আছে বাংলাদেশে পুলিশের এ এলিট ফোর্সের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত কয়েক বছর ধরে গুম-খুন সহ নানা অভিযোগ তুলে ধরছিলো র্যাবের বিরুদ্ধে। কক্সবাজারে কাউন্সিলর একরাম হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল আন্তর্জাতিক মহলে। তারও আগে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় র্যাবের ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত যা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
র্যাবের ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ঘটনায় এ বাহিনীর সাবেক প্রধান, বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। র্যাব ছাড়াও চীন, মায়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং কিছু সংস্থার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
গতকাল শুক্রবার ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি থেকে জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনে’ জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয়। এছাড়া রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ‘সেন্সটাইম গ্রুপ’কেও বিনিয়োগের কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডা ও যুক্তরাজ্যও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মিয়ানমারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর পরই ওয়াশিংটন উত্তর কোরিয়ার ওপর সর্বপ্রথম নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে।
এই নিষেধাজ্ঞার পরিণতি কী?
গতকাল শুক্রবার মার্কিন অর্থ দফতরের ‘ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস’ (ওএফএসি) বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট বলেই এই নিষেধাজ্ঞা; এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে উক্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। এরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন। আর র্যাবও প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে যেসব সহযোগিতা পাচ্ছিলো সেগুলো বাতিল হতে পারে।
একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বেনজির আহমেদ ও র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ র্যাবের আরও চারজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিদেশে সম্পদ থাকলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত হতে পারে।
দীর্ঘদিন যাবত র্যাবের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের কথা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছিলেন। এছাড়া গত বছর অক্টোবর মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কাছে সিনেটের আটজন সদস্য চিঠি দিয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে কিছু সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছিলেন। তারই ভিত্তিতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে একত্রে কাজ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে অর্থ বা ট্রেজারি বিভাগের বক্তব্য থেকে।
কতটা চাপে বাংলাদেশ সরকার?
এতদিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন গুম খুন নিয়ে নানা ধরণের বিবৃতি দিলেও সুনির্দিষ্টভাবে এই প্রথম কোন ব্যবস্থা নিল। সে কারণেই এর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে নানা মহলে।
এই নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কূটনৈতিক চাপ। নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন বাংলাদেশ সরকারের ওপর বড় ধরনের কূটনৈতিক চাপ তৈরি হল।
এতদিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও, বাংলাদেশের সরকার খুব একটা কর্ণপাত করেনি, নির্লিপ্তভাবে উল্টে এর প্রতিবাদ করেছে৷ আর সরকারি দলের নেতারা মণ্ডুপাত করেছেন মানবাধিকার কর্মীদের৷
তবে ২০১৫ সালের দিকে সরকারি দলের একাধিক এমপি-র তোপের মুখে পড়েছে র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ ফলে সরকারও ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে৷ রাজধানীতে ছাত্রলীগের এক নেতার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে র্যাবয়ের একটি ব্যাটেলিয়নের প্রধানকে প্রত্যাহার করা হয়৷ ওই কর্মকর্তারসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে নিহত ছাত্রলীগ নেতার ভাই আদালতে নালিশী মামলা করেন৷
এবার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে সরকারের অবস্থান কী হবে এটাই দেখার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে র্যাবের যে কার্যক্রম, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ ও বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বরাত দিয়ে বলা হয়, র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। কিছু প্রতিবেদন বলছে, এসব ঘটনা বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মীদের ওপরও ঘটানো হয়েছে।
‘আমরা কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করি না’
র্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ বিষয়ে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ (কেএম) আজাদ বলেন, আমরা কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করি না। সব সময় মানবাধিকার রক্ষা করি।
তিনি বলেন, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, খুন করে, ধর্ষণ করে মাদক ব্যবসা চালায়, দেশ এবং জনগণের স্বার্থেই আমরা তাদের আইনের আওতায় আনি। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকে, তাহলে দেশের স্বার্থে এই মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে আমাদের আপত্তি নেই।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, কোনো অস্ত্রধারী যদি আমাদের ওপর গুলি চালায় তাহলে কী আমরা প্রতিরোধ করব না। আমরা কি গুলি খাওয়ার জন্য বুক পেতে দেব?
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, বিষয়টি আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে অবগত হয়েছি। এ বিষয়ে অফিশিয়ালি এখনো কোনো কিছু জানি না। অফিশিয়াল কোনো চিঠি না পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারছি না। অফিশিয়াল চিঠি পাওয়ার পর, আমরা এই বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১০
আপনার মতামত জানানঃ