প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাজনের অরণ্য। হারাতে বসেছে সেখানে বসবাসকারী উপজাতিদের অস্তিত্বও। সম্প্রতি এমন আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছে ব্রাজিলের একাধিক অরণ্য ও উপজাতি সুরক্ষা সংগঠন। আর এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাস করছেন পিরিপকুরা উপজাতির মানুষরা।
প্রহরের সূত্র মতে, ১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত এই উপজাতির অস্তিত্বের কথাই জানতেন না কেউ। সভ্য সমাজের কাছে সবচেয়ে নতুন উপজাতি এই পিরিপকুরা। তাদের জীবনযাত্রাও তাই অনেকটাই দূরবর্তী। সরকারিভাবে তাদের বসবাসের এলাকাকে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও ক্রমশ সেখানে সভ্য মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটছে। সেইসঙ্গে আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে উপজাতির মানুষদের জীবন।
১৯৮০ সালে পিরিপকুরা উপজাতির দুজন সদস্যকে নাগরিক জীবনে নিয়ে আসার চেষ্টা চলেছিল। তার মধ্যে রিতা পিরিপকুরা আজও জীবিত আছেন। স্থায়ীভাবে পিরিপকুরা উপজাতির মানুষদের সঙ্গে আর থাকতে পারেন না তিনি। তবে মাঝেমাঝেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান। তার দুই ভাইয়ের ছেলে পাকিই এবং তামান্ডুয়া আজও উপজাতির সঙ্গেই থাকেন। এছাড়া এই উপজাতির আর কোনো সদস্যের কথা জানা যায় না।
তবে রিতার মতে, আরও অন্তত ১৩ জন পিরিপকুরা বেঁচে রয়েছেন। কিন্তু কতদিন বেঁচে থাকতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি স্যাটেলাইট প্রেরিত একটি ছবিতে দেখা গিয়েছে, পিরিপকুরাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩১ হাজার হেক্টর অরণ্যের মধ্যেই গড়ে উঠেছে অন্তত ৪টি পশুখামার। পশুদের খাবারের জন্য অরণ্য ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে তৃণভূমি। এমনকি এই অঞ্চলের ওপর দিয়েই পাকা রাস্তা নির্মাণের কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর অরণ্যনীতি নিয়ে বহুবার সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই পরিবেশ সংকটের সময় দাঁড়িয়েও তিনি অরণ্যের চেয়ে শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন বারবার। এমনকি পিরিপকুরা উপজাতির সংরক্ষিত অঞ্চলে খননকার্যের জন্য জমি লিজ দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
তবে শেষ পর্যন্ত নাগরিক সমাজ থেকে প্রতিবাদ ওঠায় ৬ মাসের জন্য সমস্ত প্রকল্প বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু স্থায়ী কোনো পরিকল্পনাই নেওয়া হয়নি। এদিকে ১৯৮০ সালে সভ্য মানুষদের সংস্পর্শে আসার পর অন্তত ২ বার ভয়ঙ্কর মহামারীর কবলে পড়েছিলেন পিরিপকুরা উপজাতির মানুষরা।
সেই আতঙ্ক থেকেই আরও বেশি করে দূরত্ব রেখে চলেছেন তারা। বনকর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন না তারা। এমনকি এই দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বারবার বাসস্থান বদলাতে হয়েছে তাদের। তাই কৃষিকাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। অবশ্য পিরিপকুরা উপজাতির মানুষরা পুরোপুরি শিকারী এবং সংগ্রাহক নন। দীর্ঘদিন ধরেই কৃষিকাজ করে আসছেন তারা।
সরকারি অরণ্যনীতির জন্য এভাবেই বদলে যাচ্ছে উপজাতির মানুষদের জীবনযাত্রা। সঙ্গে সবসময় আতঙ্ক তো রয়েছেই। তাছাড়া পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে সবচেয়ে বেশি অরণ্যনিধন ঘটেছে পিরিপকুরাদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলেই।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে গোটা উপজাতিটিই যে হারিয়ে যাবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সময় থাকতে কি আদৌ সচেতন হবে কর্তৃপক্ষ? ১২ বছরের মধ্যে ব্রাজিল অংশের আমাজনের বনভূমি সর্বোচ্চ ধ্বংস হয়েছে গত এক বছরে। দেশটির মহাকাশ সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি অনলাইন এই তথ্য জানায়।
ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্রাজিলের আমাজনের বন ধ্বংস সবচেয়ে বেশি হয়েছে গত এক বছরে।
২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশটির আমাজনের মোট ১১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার বন ধ্বংস হয়েছে। উজাড়ের এই হার আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, গত ১২ মাসে ব্রাজিল অংশের আমাজনের যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়েছে, তার আয়তন ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র জ্যামাইকায় চেয়ে বড়।
আমাজনকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয়। এই বন বিপুল পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কাজ করে। এ ছাড়া বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ অক্সিজেনের উৎস আমাজন। আমাজন প্রায় ৩০ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জইর বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর আমাজনের বন ধ্বংসের হার বেড়েছে। তিনি আমাজনে কৃষি ও খনিসংক্রান্ত কাজ উৎসাহিত করছেন।
বলসোনারো ক্ষমতায় আসার আগের বছর ২০১৮ সালে ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থার প্রতিবেদনে আমাজনের ৭ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটার বন উজাড়ের তথ্য জানানো হয়েছিল।
ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থার সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বলসোনারোর আমলে আমাজনে বন উজাড়ের পরিমাণ অনেক বেড়েছে।
বিবিসি বলছে, ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থার সবশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য এসেছে, তা প্রাথমিক। আগামী বছরের শুরুর দিকে পূর্ণাঙ্গ আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করার কথা রয়েছে সংস্থাটির।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৩
আপনার মতামত জানানঃ