কোনো রানীর কথা উঠলেই কল্পনায় ভেসে ওঠে একজন সম্ভ্রান্ত নারীর মুখ। যার মাথায় রয়েছে বিশাল মুকুট এবং পরনে রয়েছে রাজকীয় পোশাক। তবে ইতিহাসে এমন অনেক রানী আছেন, যারা করে গেছেন নৃশংস কিংবা অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড? ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত রানীদের নাম নিলে রানী এনজিঙ্গার নাম উঠে আসবে শুরুর দিকেই। উঠে আসবে ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের নামও। ইতিহাস বদলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের যৌন জীবনও বেশ আলোচনার।
রানী এনজিঙ্গা অ্যাঙ্গোলার রানী। এনজিঙ্গা যেই দেশটির রানী ছিলেন, সেটি বর্তমানে অ্যাঙ্গোলা নামে পরিচিত। রানী এনজিঙ্গা তার ভাইয়ের কাছ থেকে শাসন ছিনিয়ে নেন। সেই সময়ে পর্তুগীজরা এনডোঙ্গো এবং আশেপাশের অঞ্চল দখলের চেষ্টা করে যাতে বেশি পরিমাণ কালো মানুষকে বন্দি করে দাস-বাজারে বেচা যায়। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দুইবছরের মাথায় আনা এনজিঙ্গা পর্তুগীজ আক্রমণে রাজ্য ছাড়া হয়ে পড়েন। কিন্তু তবুও তিনি মাতাম্বা নামে পাশের একটি রাজ্য জয় করতে সক্ষম হন।
আনা এনজিঙ্গা দীর্ঘদিন অ্যাঙ্গোলাতে পর্তুগীজ বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছেন কালো মানুষদের মুক্ত করতে, চেষ্টা করেছিলেন পর্তুগীজদের হাতে বন্দি কালোদের মুক্তির জন্য আশ্রয় এবং উপায় বের করতে। তবে সময় অনুকূলে ছিল না। কালো মানুষদের মুক্তির দিশারী আনা এনজিঙ্গা মারা যান ১৬৬৩ সালে। তবে মরার আগ পর্যন্ত তিনি প্রভাবের সাথেই পর্তুগীজ বাহিনীর সাথে শান্তি সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন এবং মাতাম্বার সাথে পর্তুগিজ বাহিনীর সমঅধিকারের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
এই মহান বিদ্রোহী স্বাধীনতাকামী আনা এনজিঙ্গা’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ২০০২ সালে অ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডাতে তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যে এই মহান নারী প্রতিরোধ এবং সাহসের নিদর্শন বহন করে দাঁড়িয়ে আছেন।
তবে আনা এনজিঙ্গার যৌন জীবন ছিল বিতর্কিত। জানা যায়, তিনি তার দেশের সব সুদর্শন পুরুষদের নিয়ে প্রাসাদে একটি হেরেম তৈরি করেছিল এবং প্রতি রাতে হেরেম থেকে দুজন পুরুষকে তিনি বাছাই করে নিতেন। এই দুজন পুরুষকে তার সামনে লড়াই করতে দেয়া হতো।
যেই পুরুষ লড়াইয়ে বিজয়ী হতো তার সঙ্গে রানী রাত্রিযাপন করতেন এবং যিনি হেরে যেতেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। যে পুরুষ লড়াই করে বিজয়ী হতো তার ভাগ্যও খুব ভালো নয়। কারণ রানীর সঙ্গে রাত্রিযাপন করার পরই বিজয়ী পুরুষকে মেরে ফেলা হতো।
ইতিহাসের এমন আর একজন রানী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট। ক্যাথরিন দ্য গ্রেট ছিলেন রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী। তার শাসনকাল ছিল ১৭৬২ থেকে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত। তিনি খুবই দায়িত্ববান ও ভালো নেত্রী ছিলেন। কিন্তু তার এই ভালো দিকের পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে ছিল। তার বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ আছে যে তিনি একটি ঘোড়ার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছিলেন।
ক্যাথরিন সবসময় বিভিন্ন ধরনের পুরুষদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতেন এবং তাদের সন্তান প্রসব করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি যেন তেন কোনো পুরুষের সঙ্গে রাত্রিযাপন করতেন না। তিনি ভালো পুরুষ খোঁজার জন্য তার বান্ধবীকে ব্যবহার করতেন।
আগের দিন তার বান্ধবী একজন পুরুষের সঙ্গে রাত্রিযাপন করতেন এবং পরের দিন সকালে তার কাছে সে পুরুষ সম্পর্কে বিবরণ দিতেন। বিবরণ শুনে যদি তার ভালো লাগতো তাহলে সে সেই পুরুষের সঙ্গে রাত্রিযাপন করতেন এবং তার সন্তান ধারণ করতেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, নিজের সামরিক উপদেষ্টা গ্রিগরি পোতেমকিনের সঙ্গে গোপন প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন ক্যাথরিন। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ‘মাই টাইগার’ সম্বোধন করে তাকে নিয়ে লিখেছিলেন ক্যাথরিন। কিন্তু তার গোপন প্রেমের সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়নি। ধারণা করা হয়, পোতেমকিনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় ক্যাথরিন একাধিক প্রেমে লিপ্ত ছিলেন। তার প্রেমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন সেনাসদস্য।
এত এত গুঞ্জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল প্রিন্স প্লাটন জুবভের সঙ্গে ক্যাথরিনের প্রেমের সম্পর্কটি। অন্যসব ঘটনার মতো এটি গোপন রাখতে পারেননি তিনি। কারণ প্রিন্স জুবভ ছিলেন ক্যাথরিনের চেয়েও ৩৮ বছরের ছোট। তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কারণে সেকালে তরুণ প্রিন্স জুবভ হয়ে ওঠেন রাশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষদের একজন। তবে রাশিয়ার বাইরের বিখ্যাত ব্যক্তিরাও ক্যাথরিনের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। শোনা যেত, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছদ্মবেশে তাকে দেখার জন্য রাশিয়ায় গমন করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে এত এত আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিলেও ক্যাথরিন নিজের নীতিতে সবসময় অটুট ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন রাশিয়াকে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে বের করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলতে। ক্যাথরিনের মতে, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হতে দরকার ছিল রাশিয়ানদের মাঝে আলোকিতকরণের মূল্যবোধ প্রবর্তনের পাশাপাশি চারুকলার প্রচারে বিপুল অর্থ ও শক্তি বিনিয়োগ করা।
এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপোলের চিত্রকর্ম, ফ্রান্স থেকে সাংস্কৃতিক ধন-রত্ন কিনে সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন ক্যাথরিন। এটি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জাদুঘর হিসেবে সুখ্যাতি না পেলেও এর দেয়ালে দেয়ালে ৩৮ হাজার বই এবং ১০ হাজার চিত্রকর্ম রাখা হয়েছিল।
ইতিহাসবিদদের মতে, ক্যাথরিনের নির্দেশে বার্ষিক বাজেটের ১২ শতাংশ সংগ্রহশালার জন্য ব্যয় করা হত। তার এমন কার্যক্রমের জন্য অনেকে তাকে উচ্চাভিলাষী সম্রাজ্ঞী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা চিন্তা করলে দেখা যায়, তার কল্যাণেই রাশিয়ান সংস্কৃতিতে স্বর্ণযুগের শুভসূচনা ঘটেছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/২১০৫
আপনার মতামত জানানঃ