ঠিক যেন সৈরাত মুভি। ২০১৬ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রে মারাঠি সিনেমা সৈরাত নির্মাণ হয় ১ কোটি টাকায়। এরপরই ইতিহাস। ১ কোটির মুভিটি ১০০ কোটির ওপরে ব্যবসা করে এবং গোটা ভারতসহ বিশ্বে তুমুল আলোচনায় চলে আসে। এরপর রিমেইক হতে থাকে বলিউড থেকে শুরু করে দেশটির নানা রাজ্যে নানা ভাষায়। দেশটির বাইরেও এর রিমেইক হতে থাকে।
মুভিটি নির্মিত হয় একটি সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করে। ধনী পরিবারের এক কিশোরী গরিব পরিবারের এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। বিয়ে করে, একটি ফুটফুটে সন্তানও হয়। শুরু থেকেই মেয়েটির ধনী পরিবার এই বিয়ে মেনে নেয়নি। একদিন খোঁজ পায় তাদের কন্যার। তারপর পরিবারের লোকজন সমঝোতা হিসাবে বেড়াতে এসে নিজেদের কন্যা ও তার স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করে।
তেমনি আরেকটি ঘটনার জন্ম হয় ভারতের একই রাজ্য মহারাষ্ট্রে। ভারতের মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলায় ১৯ বছর বয়সী গর্ভবতী এক তরুণীকে গলা কেটে হত্যা করেছে তার মা ও ভাই। তারপর পরিবারের লোকজন সেলফি তুলে, বাড়ির বাইরে বের হয়ে উল্লাস করেছে। পরে নিজেরাই পার্শ্ববর্তী থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তারা। পুলিশের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তরুণীর জামাইকেও হত্যা করার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। গতকাল রবিবার (৫ ডিসেম্বর) এ ঘটনা ঘটে। প্রতিবেশিদের অভিযোগ, হত্যা করার পর ওই তরুণীর বিচ্ছিন্ন মাথা নিয়ে সেলফি তুলেছেন তার ভাই ও মা। সেটি নিয়ে এখন তদন্ত করছে পুলিশ।
কীর্তি থোর নামের ওই তরুণী গত জুনে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এরপর থেকেই সে বরের সঙ্গে বসবাস করছিল। গত সপ্তাহে তরুণীর মা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দেখা করতে বলে। গতকাল রবিবার ছেলেসহ মেয়ের বাড়িতে যান ঘাতক মা।
পুলিশ জানিয়েছে, যখন তারা মেয়ের বাড়িতে পৌঁছায় তখন কীর্তির জামাই অন্য একটি রুমে ছিল। এরপর কীর্তি তার মা ও ভাইয়ের জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে যায়। ঠিক তখনই পেছন থেকে মা এসে তার পা চেপে ধরে এবং ভাই ছুরি দিয়ে শরীর থেকে মাথাটিকে আলাদা করে ফেলে। এর পরই ঘটনাটি প্রতিবেশিদের চোখে পড়ে।
পরে অভিযুক্তরা ভিরগাঁও পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তাদেরকে এখন গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
জানা গেছে, শিরশ্ছেদের শিকার তরুণী গর্ভবতী ছিলেন। তার কাটা মাথা প্রতিবেশীদের দেখিয়েছেন মা শোভা সঞ্জয় মোটে এবং ভাই সঙ্কেত সঞ্জয় মোটে। না জানিয়ে বিয়ে করার বিষয়টিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে তার শিরশ্ছেদ করেছেন পরিবারের লোকেরা। আর এ ঘটনাকেই উৎকৃষ্ট বলে মনে করেছে তারা।
নিহত তরুণীর ভাই প্রতিবেশীদের জানিয়েছে, বোন না জানিয়ে বিয়ে করার কারণে তার শিরশ্ছেদ করে পরিবারের সম্মান ফেরানো হয়েছে।
অনার কিলিং বা পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে হত্যা বাড়ছে ভারতে। প্রতি বছর ঠিক কতজন মেয়ে বা মহিলাকে এভাবে জীবন দিতে হয় তার সঠিক কোন তথ্য নেই৷
চলতি বছরের গত এপ্রিলেও অনার কিলিংয়ের নামে ১৯ বছরের এক তরুণীকে খুন করে বাবা-মা ও পরিবারের ৫ জন। এমন কী, লকডাউনের মধ্যেই চুপিসারে ওই তরুণীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ফেলেছে বলেও জানা গিয়েছে।
কীর্তি তার মা ও ভাইয়ের জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে যায়। ঠিক তখনই পেছন থেকে মা এসে তার পা চেপে ধরে এবং ভাই ছুরি দিয়ে শরীর থেকে মাথাটিকে আলাদা করে ফেলে।
ভারতের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হলেও জাত-প্রথা নিয়ে আছে অনেক গোঁড়ামি। বর্ণের প্রভাবে হিন্দু সংস্কার এবং জন্মের সময় উচ্চবংশের সাথে নিন্মবংশের থাকে বিস্তর ফারাক।
মূলত প্রতিহিংসামূলক কর্মকান্ডের জন্য পরিবার, ছেলে এবং মেয়েকে হত্যা করার চেষ্টা করে। পরিবারের কাছে বিয়ের চেয়ে জাত-ধর্ম-বর্ণ তখন মূখ্য হয়ে যায়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেবে, ২০১৬ সালেই অন্তত ৭৭টি হত্যাকাণ্ড রিপোর্ট হয়েছে যেগুলোকে ‘অনার কিলিং’ বলা হচ্ছে।
ভারতে ইদানিং যা দেখা গেছে তা হল বর্ণাশ্রম না মেনে নিজের জাতের বাইরে কেউ যদি বিয়ে করে তাহলে পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়েছে এমনটি ধরে নেয়া হয়৷ তখন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা প্রতিশোধ নিতে উঠে পড়ে লাগে৷ যেভাবেই হোক পরিবারের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে এবং তা করা যাবে যদি মেয়েটিকে হত্যা করা হয়৷ এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে বাবা-ভাই, আত্মীয় স্বজনরা পর্যন্ত থাকে৷ কিন্তু অত্যন্ত আদরের কন্যা বা বোনকে হত্যার পর পরিবারের সম্মান কি আদৌ ফিরে আসে?
এসব ‘অনার কিলিং’-এর ঘটনা মূলত গ্রামে দেখা যায় বেশি৷ সেখানে পঞ্চায়েত বা গ্রাম্য আদালত বেশির ভাগ সময়ে শাস্তির বিধান দেয়৷ তাদের কাছে জাতপাতের বিষয়টা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ৷ তারাই এসব ‘অনার কিলিং’–এ গ্রামের সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করে৷
ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলেন, এই অনার কিলিং-এর পেছনে যে মানসিকতা কাজ করে তা হল পুরনো দিনের সেই মানসিকতা৷ আমার জাতের বা গোত্রের বাইরে বিয়ে করলে অথবা যদি বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি বিয়ে করি তখন আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়৷ পরিবারের সদস্যরা তখন গর্ববোধ করে যে যারা পরিবারের বিরোধীতা করেছে তাদের মেরে ফেলা উচিৎ৷ শুধু যে বিয়ে করেছে তাকে মেরে ফেলা নয় যাকে বিয়ে করা হয়েছে তাকেও মেরে ফেলা হয়৷ এটা বহু বছর ধরে চলে আসছে৷ আর এ ধরণের ঘটনা সবচেয়ে দেখা যায় পাঞ্জাবে৷ তবে হরিয়ানাতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ চণ্ডিগড়েও দেখা যায় অনার কিলিং-এর ঘটনা৷ এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে দিল্লী আর কেরালাতেও এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে৷
ভারতে প্রতি বছর ঠিক কত মেয়ে অনার কিলিং-এর শিকার হয় তার কোন সঠিক হিসাব নেই৷ তবে ধরে নেয়া হয় যে প্রায় ৯০০ মেয়ে প্রতি বছর এর শিকার৷ যে সব প্রদেশে এসব ঘটনা ঘটে তার মধ্যে হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশ উল্লেখযোগ্য৷
এছাড়া অনেক ‘অনার কিলিং’-এর কাহিনী গোপন থাকে৷ পুলিশের কাছে পর্যন্ত তা নিয়ে কোন রিপোর্ট করা হয়না৷ অনেক সময় পুলিশ নিজেও না দেখা বা না জানার অভিনয় করে৷ কারণ তাদের মধ্যেও এমন অনেকে আছে যারা বিশ্বাস করে যে ‘অনার কিলিং’-এর প্রয়োজন রয়েছে৷
অনার কিলিংয়ের প্রভাব এখন পুরো বিশ্বব্যাপী। প্রতি বছর অসংখ্য নারী শিকার হচ্ছে এর। জাতিসংঘের অনুমানে সেই হিসেব ২০০০ থেকে ৫০০০। বিভিন্ন মানবিক সংস্থার উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বিবিসির এক রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা ২০,০০০।
ক্রমবর্ধমান আরব, পাকিস্তানি, ও আফগান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে গড়ে ওঠা বা বসতি স্থাপনের ফলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া’সহ অন্য আরও দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে এই হিংস্র প্রথা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্মান রক্ষার্থে খুন— অনার কিলিং। শব্দগুলো আর নতুন করে স্তম্ভিত করে দেয় না। মেয়েরা এখন এই শব্দগুলো শুধু নয়, এই মৃত্যুগুলোর সঙ্গেও পরিচিত। অনেক বছর হয়ে গেল এই নৃশংসতার, তাই মেয়েরাও বোধহয় এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারাও জেনে গেছে যে যেকোনও সময়ে পরিবার, সমাজ সব জায়গা থেকে বীভৎসতম আঘাতটা তারা পেতে পারে। যত বড় চাকরিই করুক বা যত সহজ-সাধাসিধে একটা জীবনের স্বপ্নই দেখুক না কেন, জীবনটা যখনই নিজের হাতে নিতে চান, যেমনই হোক একটা নিজস্ব যাপনের চিন্তা করেন, তখনই মেয়েদের জীবনটাই একটা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া সবই যেন অন্যের উপর নির্ভরশীল— বিশেষত পরিবারের পুরুষদের। অবশ্য মানসিকতাটা যেখানে পুরুষতান্ত্রিক, সেখানে পুরুষ, নারী নির্বিশেষে যে কেউই এই নির্যাতনে, এই হত্যায় শামিল হয়ে যান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৭
আপনার মতামত জানানঃ