পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া একটি ছবি। পোষ্য কুকুরকে নিয়ে খেলা করছে বছর দশেকের এক কিশোরী। আর তার খেলার সঙ্গী বছর পাঁচেকের এক শিশু। দু’জনের মুখের মিলও বিস্তর। দেখলে ছোট্ট শিশুটিকে কিশোরীটির নিজের ভাই বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আদতে না। শিশুটি মূলত ওই কিশোরীটির সন্তান?
অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। মানুষ তথা জীবজগতের রহস্য এমনই বিস্ময়কর। মাত্র ৫ বছর ৮ মাস বয়সেই মা হয়েছিলেন পেরুর বাসিন্দা লিনা মেডিনা। বিশ্বের ইতিহাসে লিনাই সর্বকনিষ্ঠ মা। কিন্তু এমন অস্বাভাবিকতার কারণ কী?
এর উত্তর জানার আগে যাওয়া যাক প্রশ্নের গভীরে। পিছিয়ে যাওয়া যাক সাড়ে আট দশক। লিনার জন্ম হয়েছিল পেরুর টিক্রাপোতে। বাবা ছিলেন টিবুরেলো মেদিনা এবং মা ভিক্টোরিয়া লোসিয়া। লিনারা ছিলেন ৯ ভাইবোন। তবে শারীরিক দিক থেকে বাকিদের থেকে যেন একটু দ্রুতই বেড়ে উঠছিলেন লিনা। বিষয়টি চোখে পড়লেও প্রাথমিকভাবে ততটা গুরুত্ব দেয়নি তার পরিবার।
তবে সাড়ে পাঁচ বছরের লিনার তলপেটের আয়তন আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পেলে আশঙ্কা জন্মায় তার মায়ের মনে। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে দ্বারস্থ হন লিনার বাবা-মা। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল হয়তো টিউমর বেড়ে উঠছে লিনার গর্ভে।
তবে সেই ভুল ভাঙে পিকসো হাসপাতালে তার শারীরিক পরীক্ষা করার পর। না, টিউমর নয়। বরং, লিনা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল মেডিনা পরিবারে। এতটুকু বয়সে লিনা গর্ভবতী হওয়ায়, জন্ম নেওয়া সন্তান আদৌ স্বাভাবিক হবে কিনা— তা নিয়েও ঘনিয়েছিল সন্দেহের মেঘ।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যখন লিনার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তখন তার বয়স ৫ বছর আট মাস। অবাক করার বিষয় হল, সবদিক থেকেই সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল লিনার সন্তান। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ২ কেজি ৭০০ গ্রাম। ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক জেরার্ডো লোজাডার নামেই নামকরণ করা হয় সদ্যজাতের।
তবে এসবের মধ্যেই আরও একটি বিষয় প্রকাশ্যে আসে। তা হল, পাঁচ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই লিনা শিকার হয়েছেন যৌন নির্যাতনের। অভিযোগের আঙুল ওঠে স্বয়ং তার বাবার দিকেই। তাকে গ্রেপ্তারও করে পেরুভিয়ান পুলিশ। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভুল প্রমাণিত হয় সেই সন্দেহ।
কিন্তু জেরার্ডোর বাবা কে? এ যেন এক রহস্যই হয়েই থেকে গেছে আজীবন। কিশোরী লিনাও তেমন কোনো অর্থবহ তথ্য দিতে পারেনি যৌন নির্যাতনের বিষয়ে। ফলে, গোটা মামলাটাই ধামাচাপা পড়ে যায় সময়ের সঙ্গে।
আর পাঁচ জন মানুষের মতো জেরার্ডোও ছোটো থেকে লিনাকে জেনেছিল তার দিদি হিসাবেই। বছর দশেক বয়সে প্রথম জেরার্ডো জানতে পারে লিনা আদতে তার মা। তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বজুড়েই সাড়া পড়ে গিয়েছিল লিনার মাতৃত্ব নিয়ে। সাংবাদিক এবং বিজ্ঞানীদের ঢল নামত পেরুর টিক্রাপো শহরে।
গবেষণায় উঠে আসে, মাত্র ৯ মাস বয়স থেকেই ঋতুমতী লিনা। জানা যায়, অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের অস্বাভাবিক ক্ষরণই এই ঘটনার অন্যতম কারণ। কিশোর বয়স থেকেই সক্রিয়ভাবে যৌন হরমোনের নিঃসরণ শুরু হয়েছিল তার এই গ্রন্থি থেকে।
বিরলের মধ্যেও বিরলতম বলা চলে এই ঘটনাকে। তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির জন্যও বড়ো অঙ্কের প্রস্তাব দেয় একাধিক সংস্থা। তবে রাজি হননি লিনা। পরবর্তীতেও কোনোদিন সংবাদমাধ্যমের সামনে এই বিষয়ে মুখ খোলেননি তিনি। দেননি সাক্ষাৎকারও।
আঠারোতে পা দেওয়ার আগে থেকেই নিজের সন্তানকে বড়ো করে তোলার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন লিনা। পিকসো হাসপাতালেই কাজ করতেন চিকিৎসক জেরার্ডোর সহকারী হিসাবে। বিবাহের পর ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় লিনার দ্বিতীয় সন্তান। তার বছর সাতেকের মধ্যেই ১৯৭৯ সালে মারা যায় প্রথম সন্তান জেরার্ডো। আকস্মিকভাবেই শুকিয়ে গিয়েছিল জেরার্ডোর অস্থিমজ্জা।
বর্তমানে লিনার বয়স ৮৯ বছর। পেরুতেই দ্বিতীয় সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন ‘বিস্ময়-কিশোরী’। তবে সাড়ে আট দশক পেরিয়ে আসার পরেও, আজ তাকে নিয়ে গবেষকদের আগ্রহ কমেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ