নতুন একটি চাঁদ খুঁজে বার করে ফেললেন ভারতের চেন্নাইয়ের এক সাংবাদিক। যদিও সাংবাদিকতা ছেড়েছুড়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছেন কয়েক বছর আগে। দিল্লি আর চেন্নাইয়ের বাড়িতে তার যা কিছু ছিল, সব বিক্রি করে চলে যান আমেরিকায়। সেখানেই দু’-দু’টি টেলিস্কোপের চোখ দিয়ে পৃথিবীর লুকিয়ে থাকা এই চাঁদ আবিষ্কার করলেন তিনি। দেখলেন, আধা চাঁদ একা একা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে প্রায় পৃথিবীর পথ ধরেই।
মূলত চাঁদ থেকেই ছিটকে বেরিয়ে এসেই এই আধা চাঁদ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীরই ঘেঁষাঘেঁষি কক্ষপথে। তাই তা এত দিন আমাদের নজর এড়িয়ে থাকতে পেরেছিল।
দিল্লির একটি সংবাদমাধ্যমের নিউজরুম ছেড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে যাওয়া আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বিষ্ণু রেড্ডি পৃথিবীর যে লুকিয়ে থাকা চাঁদের হদিশ দিয়েছেন, সেটি এই নীলাভ গ্রহের পঞ্চম আধা চাঁদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘কোয়াসি স্যাটেলাইট’।
লুকোনো পঞ্চম চাঁদে শরীর গড়া সিলিকেটে। যা পৃথিবীতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। রয়েছে চাঁদেও। তবে এই সিলিকেট পাওয়া সম্ভব নয় পৃথিবীর কাছেপিঠে থাকা অন্য গ্রহাণু-সহ অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তু বা নিয়ার-আর্থ অবজেক্টেও (এনইও)। এ থেকেই স্পষ্ট হলো যে, এটা মূলত চাঁদেরই অংশ।
কোনও বিশাল গ্রহাণু বা উল্কাখণ্ড আছড়ে পড়ায় যা চাঁদ থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়েছে মহাকাশে। যে ভাবে কয়েকশো কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকেই ছিটকে বেরিয়ে গিয়েই চাঁদ হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর চাঁদ।
এটির প্রথম খোঁজ মেলে ২০১৬ সালে। কিন্তু তখন ভাবা হয়েছিল এটি পৃথিবীর কাছেপিঠে থাকা কোনও নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট। ছোট গ্রহাণু বা তার কোনও অংশ। সেই সময় তার নাম দেওয়া হয় ‘২০১৬-এইচও-তিন’।
বিষ্ণুর গবেষণা সেই ভুল ভাঙিয়ে দিল। জানাল, এটি আদতে চাঁদেরই একাংশ। যার নতুন নাম এখন ‘কামোভালেভা’। বিষ্ণু ও তার সহযোগীদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘কমিউনিকেশন্স আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এ।
কামোভালেভার মতো পৃথিবীর আরও চারটি আধা চাঁদ আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে। তারাও যে চাঁদেরই অংশ, তা জানা গিয়েছে। কিন্তু এই পঞ্চমটিকে নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। বিষ্ণু ও তার সহযোগীদের গবেষণা সেই সংশয় দূর করল লার্জ বাইনোকুলার টেলিস্কোপ ও হ্যাপি জ্যাক টেলিস্কোপের মাধ্যমে।
গবেষক বিষ্ণু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা কামোভালেভাকে দেখেছি আলোক বর্ণালির দু’টি তরঙ্গে। দৃশ্যমান আলো আর অবলোহিত রশ্মিতে। অবলোহিত রশ্মিতেই দেখা যায় এর শরীর সিলিকেট দিয়ে গড়া। যা পৃথিবীতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। চাঁদ থেকেও যা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন অ্যাপোলো-১৪-এর মহাকাশচারীরা ১৯৭১ সালে।
এই সিলিকেট সাধারণত কোনও নিয়ার-আর্থ অবজেক্টে থাকে না। তাই আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এটি কোনও নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট নয়। চাঁদেরই অংশ। চাঁদ থেকেই ছিটকে বেরিয়ে এসে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীরই ঘেঁষাঘেঁষি কক্ষপথে। তাই তা এত দিন আমাদের নজর এড়িয়ে থাকতে পেরেছিল। চাঁদও এক দিন এই ভাবেই ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে।
আকারে কামোভালেভা অনেকটা সেই ‘লন্ডন আই’ (যার আর এক নাম ‘ফেরিস্ হুইল’)-এর মতোই। ১৩৫ ফুট উচ্চতার লন্ডন আইয়ের মাথায় চড়লে লন্ডন শহর আর তার চার দিকের ২৫ কিলোমিটার এলাকার সব পথঘাটও স্পষ্ট দেখা যায়।
বিষ্ণুর জন্ম চেন্নাইয়ের কাছে একটি গ্রামে। ১৯৭৮-এ। বাবা, মা দু’জনেই চিকিৎসক। গ্রামেই চিকিৎসা করতেন। তিনি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতে ঢুকেছিলেন দিল্লির একটি সংবাদমাধ্যমে; কপি এডিটরের কাজ। হঠাৎই কাজের সুবাদে তাকে যেতে হয়েছিল আরিজোনায়। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গ্রহাণু সংক্রান্ত অনুষ্ঠান কভার করতে।
সেখানে গিয়েই গ্রহাণুর প্রেমে পড়ে যান তিনি। তার পর দেশে ফিরে কাজের ফাঁকে রাত জেগে পড়াশোনা করে জিআরই পরীক্ষায় পাশ করে দিল্লির চাকরি ছেড়ে পাড়ি জমান আরিজোনায়। শুরু করেন তার অধ্যাপনা ও গবেষণার জীবন।
৪৩ বছর বয়সি বিষ্ণু বলেন, সেই থেকেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এখন আমি এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীকেই বিয়ে করেছি। স্ত্রীর নাম লরেল। বিষ্ণুর জোরালো আশা, চাঁদ নিয়ে আরও কিছু অবাক করে দেওয়ার মতো খবর তিনি দিতে পারবেন কিছু দিনের মধ্যেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৭
আপনার মতামত জানানঃ