পশ্চিমা-বিশ্ব সমর্থিত ক্ষমতাসীন সরকারের পতন এবং কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর গভীর সঙ্কটে পড়েছে আফগানিস্তান। তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। আফগানিস্তান অর্থনৈতিক পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; যা দেশটিকে নতুন রাজনৈতিক সংকটে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক সংকটের ব্যাপারে আবারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, দেশটির অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা পতনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। আর তাই মানবিক ও আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে আফগান ব্যাংকগুলোকে রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
সোমবার (২২ নভেম্বর) জাতিসংঘ এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। জরুরি পদক্ষেপ ছাড়া কয়েক মাসের মধ্যে আফগান ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলেও সতর্কতা উচ্চারণ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক সোমবার নিউইয়র্কে বলেন, আফগানিস্তানের ক্রেডিট মার্কেটে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বহুগুণে বেড়েছে। দেশটিতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২০২০ সালে যেখানে ছিল শতকরা ২০ ভাগ, সেটি চলতি বছরে ৫৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএনডিপি।
ডুজারিক জানান, ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা তাদের পুঁজি তুলে ফেলছেন যা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ ব্যাংকে জনগণের গচ্ছিত অর্থ শতকরা ৪০ ভাগ কমে যাবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই মুখপাত্র আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের জন্য সাহায্যের আবেদনে যে সাড়া পাওয়া গেছে তাতে ৬০ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের তহবিল সংগৃহিত হয়েছে এবং এই অর্থ দিয়ে আফগানিস্তানের এক কোটি ১০ লাখ মানুষকে সেবার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
আসন্ন শীতকালকে সামনে রেখে আফগানিস্তানে দারিদ্র ও বেকারত্ব ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শীতকালে দেশটির কোনও কোনও এলাকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে চলে যায়। এ সময় বিশেষ করে দিনমজুরদের তেমন কোনও কাজ থাকে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, দেশটিতে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
এদিকে জাতিসংঘ শিশু বিষয়ক তহবিল জানিয়েছে, আফগানিস্তানের ৩০ লাখের বেশি শিশু অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই করছে। কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এর মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি শিশু মৃত্যুর মুখে পড়বে।
নাগরিক অধিকারকর্মীরা বলছেন, আফগানিস্তানে জরুরি সহায়তা না দেওয়া হলে বিশেষ করে শিশুদের পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নেবে। এমন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
দেশটিতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২০২০ সালে যেখানে ছিল শতকরা ২০ ভাগ, সেটি চলতি বছরে ৫৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আফগানিস্তানে খাদ্য সংকটে দিনাতিপাত করছে বেশিরভাগ পরিবার। আগের থেকে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা থাকলেও দেশটি তালিবানের দখলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে চরম অস্থিতিশীলতার দাঁড়প্রান্তে দাঁড়িয়েছে। এরপর থেকে সেখানে খাদ্যের অভাব বিস্তৃত হতে শুরু করে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানাচ্ছে, ১ কোটি ৪০ লাখ লোক ক্ষুধার্ত। যাদের মধ্যে ২০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং জীবন রক্ষার জন্য তাদের বিশেষ পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন। দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। লোকজন বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের খাদ্য কেনারও পয়সা নেই।
আফগানিস্তানে বেশিরভাগ মানুষের হাতে পয়সা নেই। এরমধ্যে চলছে লুটপাট। খোদ তালিবান সেনারাও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি লুট করছে। সাধারণ মানুষের আয় রোজগারের বেশিরভাগ রাস্তাই বন্ধ। বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তানে। ইতোমধ্যেই ৯৩ হাজারেরও বেশি আফগান আশ্রয় নিয়েছে পাকিস্তানে। তোরখাম সীমান্তে মানুষের ঢল সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। অথচ তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার আগে বেশ ভালোই ছিল সেখানকার মানুষ।
গত আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের আগে দেশটিতে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার আসন্ন শীতকালীন সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তা পাঠাবে। কিন্তু গনির সরকারের পতন আর তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। দেশগুলো মনে করছে, এখন যদি সহায়তা পাঠানো হয়, তাহলে সেটা তালিবানের হাতে পড়বে। এতে কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং লাভবান হবে তালিবান। সেই কারণে সাধারণ আফগানরা নানা ধরনের সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না দেশগুলো।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য। দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে। মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৬
আপনার মতামত জানানঃ