নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের নতুন জারি করা নিয়ম অনুযায়ী, দেশটির টেলিভিশন নাটকে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, নারী সাংবাদিক ও উপস্থাপিকাদেরও হিজাব পরে টেলিভিশন পর্দায় আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে কী ধরনের আবরণ বা হিজাব ব্যবহার করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশিকায় সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সাংবাদিকরা বলছেন, নতুন নিয়মের অনেক কিছুই স্পষ্ট নয়; এখানে ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।
চলতি বছরের অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালেবান। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, দেশটির নারীরদের ওপর ধীরে ধীরে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে দলটি।
যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পরপরই আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তালেবান; প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা মেয়ে শিশু ও তরুণীদের স্কুল থেকে ফেরার পর বাড়িতেই থাকার নির্দেশ দেয়।
১৯৯০-এর দশকে তালেবান সরকার তাদের আগের শাসনামলে, নারীদের শিক্ষা গ্রহণ ও বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। আর এখন সর্বশেষ তারা আফগান টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নতুন যে নির্দেশনা জারি করেছে, সেখানে মোট আটটি ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এর মধ্যে শরিয়া বা ইসলামিক আইন ও আফগান মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যায় এমন চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ভিডিও ফুটেজে পুরুষদের শরীরের অন্তরঙ্গ অংশগুলো প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
ধর্মের অবমাননা করে বা আফগানদের জন্য আপত্তিকর বলে বিবেচিত হতে পারে, এমন কমেডি ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানও নিষিদ্ধ করা হয়েছে নতুন নির্দেশনায়।
তালেবানের মতে, ভিনদেশী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রচার করে এমন চলচ্চিত্র সম্প্রচার করা উচিৎ নয় দেশে। আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি নাটক দেখানো হয়, যেগুলোর প্রধান চরিত্রে থাকেন নারী।
এদিকে, আফগানিস্তানে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘হুজ্জাতুল্লাহ মুজাদ্দেদির’ এক সদস্য বলেছেন, নতুন এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা অপ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন, কিছু নিয়ম বাস্তবসম্মত নয় এবং তা কার্যকর হলে সম্প্রচারকারীরা টেলিভিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
আফগান নারীদের উত্থান-পতন
আফগানিস্তানে নারীদের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে ১৯৯৬ সালে তালিবান প্রথম আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করার আগে কেমন ছিল আফগান নারীদের জীবন? অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক উইলিয়াম পোডলিচ ১৯৬৭ সালে ইউনেসকোর এক প্রকল্পের আওতায় দুই বছরের জন্য কাবুলের টিচার্স কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন শৌখিন আলোকচিত্রী। পোডলিচের তোলা ছবিগুলোয় তালিবানের ক্ষমতা দখলের আগের আফগান নারীদের জীবনযাত্রার আন্দাজ মেলে। সে সময়ের আফগান নারীরা পাশ্চাত্য পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে বাসে যাতায়াত করতেন এবং শপিং মলে যেতেন। স্কুল-কলেজে নারীদের পড়াশোনা, গানবাজনা, খেলাধুলার ছবিও উঠে এসেছে পোডলিচের ক্যামেরায়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবান শাসনামলে নারীদের জীবনযাপন বদলে যায়। ১৯৯৯ সালে তালিবান শাসনামলে থাকা এক নারীর বর্ণনায় উঠে আসে তাদের সে সময়ের কষ্টের জীবনের কথা। ফিব্রা নামের সেই নারীর বয়স এখন ৩২ বছর। থাকেন লন্ডনে। ১৯৯৯ সাল ছিল ফিব্রার শৈশবকাল। ফিব্রারা ছিলেন চার বোন ও এক ভাই। ফিব্রার বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তালিবান। বাবাকে তারা আর ফিরে পাননি।
তালিবান শাসনামলে তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাবার খোঁজ করার সময় মাকেও মারধর ও হুমকি-ধমকি দেয় তালিবান। তালিবান শাসনের পতনের পর ফিব্রাদের পড়াশোনা আবার শুরু হয়। দুই দশক পর তালিবান ফিরে আসায় আফগানিস্তানে থাকা পরিবার নিয়ে এখন আবার উদ্বেগে রয়েছেন ফিব্রা।
২০০১ সালে তালিবান সরকারের পতনের পর নারীদের জীবনে আবারও বদল আসে। শুরু হয় নতুন পথচলা। নারীরা আবার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কর্মক্ষেত্রে বাড়ে নারীদের পদচারণ। সংগীত, চিত্রাঙ্কন ও খেলাধুলায় সাফল্যের ছাপ রাখতে শুরু করেন নারীরা। গণমাধ্যমেও নারীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি বাড়ে। ইউনেসকোর তথ্য অনুসারে, গত বছর আফগানিস্তানে শিক্ষার হার ছিল ৪৩। ২০১৭ সাল থেকে পরের দুই বছরে দেশটিতে শিক্ষার হার বেড়েছে ৮।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পরে দেশটির অর্থনীতি, কূটনীতি, শাসনপদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ দেখা দেয় আফগান নারীদের নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দেশ ও সংস্থা নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর সেসব উদ্বেগ যে অমূলক নয়, তার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তালিবানের অন্তর্বর্তী সরকারের বেঁধে দেওয়া নানা নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়ছেন আফগান নারীরা।
তালিবানের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী সদস্য রাখা হয়নি। এমনকি নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভবনে নারী কর্মীদের ঢুকতে দিচ্ছে না তালিবান। তালিবান সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রী আবদুল বাকি হাক্কানি আফগান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়ার কথা জানিয়েছেন। শর্ত হলো তাদের হিজাব পরতে হবে। পুরুষদের সঙ্গে ক্লাস করার অনুমতি দেওয়া হয়নি নারীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আলাদা ক্লাসের ও নারী শিক্ষকের বন্দোবস্ত করা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
তালিবান-নিযুক্ত আফগানিস্তানের খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক দপ্তরের মহাপরিচালক জানান, দেশটিতে ৪০০ ধরনের খেলাধুলার অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে এসব খেলায় নারীরা অংশ নিতে পারবেন কি না, তা স্পষ্ট করে জানাননি তিনি। এর মধ্যেই আফগানিস্তানের নারীদের ফুটবল দলের ৮০ জনের বেশি সদস্য পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। ১৫ আগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে কাবুল বিমানবন্দরে কাজ করতেন ৮০ জনের বেশি নারী। তবে এখন কাজে ফিরেছেন মাত্র ১২ জন।
জাতিসংঘের এক আফগান কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, আফগানিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে নারীদের বাইরে বের হতে বাধা দিচ্ছে তালিবান। এমনকি নারীদের চাকরি ছাড়তেও বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু খেলোয়াড় নন, আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন নারী অধিকারকর্মী, রাজনীতিক, গবেষক ও সাংবাদিকেরাও।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ