হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের পর দেশে ‘মানবিক বিয়ে’ নামে নতুন এক শব্দযুগলের আবির্ভাব ঘটে, যেটা প্রচলিত ইংরেজি শব্দে ‘লিভ ইন’ কিংবা ‘লিভ টুগেদার’ হিসাবেও বিবেচিত হয়। মামুনুল হকের পর হেফাজতের আরও কয়েক নেতার বিরুদ্ধেও এই মানবিক বিয়ের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়। এবার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইসলাম ধর্মের তীর্থভূমি সৌদি আরবেও এই মানবিক বিয়ের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। একইচিত্র দেখা গেছে ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী আরেকটি দেশ— ইরান।
বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকাকে ‘লিভ টুগেদার’ বলা হলেও ইরানে বলা হয় ‘হোয়াইট ম্যারেজ’ বা সাদা বিয়ে। ইরানী সমাজের কড়া ইসলামী আইনে নারী-পুরুষের এভাবে একসাথে থাকা—বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্কের মতই অবৈধ। কিন্তু তার পরও দেশটিতে এই সাদা বিয়ে চলছে।খবর বিবিসি
এ শতাব্দীর প্রথম দশকেও ইরানে কোনো যুবক-যুবতী সাদা বিয়ে করবে এমনটা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন দেশটিতে বিয়ের আগেই একসঙ্গে থাকছে এমন তরুণ যুগলের সংখ্যা কত তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। এটি দেশটির ইরানের কট্টরপন্থী প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে।
বেশ কয়েক বছর আগে বিবিসির ফারসি বিভাগের রানা রহিমপুর এক রিপোর্টে লিখেছিলেন, ইরানে এই ‘সাদা বিবাহে’র প্রচলন এতটাই বেড়ে গেছে যে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তোল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতি দিয়ে এ ব্যাপারে তার “গভীর আপত্তি” প্রকাশ করেছিলেন।
তার কার্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ মোহাম্মদী গোলপেগানির ইস্যু করা এক বিবৃতিতে কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল ‘কোহ্যাবিটেশন’ বা বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা নেবার ক্ষেত্রে যেন কোন দয়া প্রদর্শন করা না হয়’।
তাতে বলা হয়েছিল, ‘পুরুষ ও নারীর বিয়ে না করে একসাথে থাকা লজ্জাজনক। যেসব লোকেরা এ জীবন বেছে নিয়েছে তাদের একটি বৈধ প্রজন্মকে অবৈধ প্রজন্ম দিয়ে মুছে দিতে বেশি সময় লাগবে না’।
কিন্তু এসব সতর্কবাণী ইরানের তরুণ প্রজন্ম শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। এ শতাব্দীর প্রথম দশকেও ইরানে কোন যুবক-যুবতী সাদা বিয়ে করবে এমনটা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন এরকম অবিবাহিত দম্পতির সংখ্যা ক্রমশঃই বাড়ছে।
ইরানী মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয় সাময়িকী ‘জানান’ ২০১৪ সালে এ বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। তবে এর কয়েক মাস পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে কর্তৃপক্ষ ‘বিয়ে না করে একসাথে থাকাকে উৎসাহিত করার’ অভিযোগে ম্যাগাজিনটি নিষিদ্ধ করে। এ ব্যাপারে ঠিক কি করা যায়— এ নিয়ে ইরানি কর্তৃপক্ষ একটা দ্বিধায় আছে বলেই মনে হয়।
ইরানের যুব বিষয়ক ডেপুটি মন্ত্রী মোহাম্মদ মেহদি তন্দগোইয়ান সম্প্রতি ইরনা বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, ‘অবিবাহিত যুগলদের সন্তানদের একসময় তাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দরকার হবে— যখন তারা স্কুলে ভর্তি হতে যাবে।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হবার পরিণাম হবে বিপর্যয়কর।
ইরানে বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায়ই ব্যয়বহুল হয়, আর এর খরচ দিতে হয় বরের পরিবারকে। আর বিয়ে ভেঙে গেলে স্ত্রীকে ‘মাহরিয়েহ’ হিসেবে যে অর্থ দিতে হয়— তাও দিতে হয় স্বামীকে। এর অংক হয় বেশ বড়, আর তা না দিতে পারলে জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অধিকাংশ পর্যবেক্ষকই মনে করেন, ইরানে অনেক যুগলই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে চায় না এর কারণ হচ্ছে দেশটির ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদের হার।
ইরানের একজন সমাজকল্যাণ সংস্থার একাংশের পরিচালক ফারহাদ আঘতার বলছেন, ইরানে প্রতি পাঁচটি বিয়ের একটি বিবাহবিচ্ছেদ হয়। সারা ইরানের মধ্যে রাজধানী তেহরানে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি।
ইরানী সমাজবিজ্ঞানী মেহেরদাদ দারভিশপুর বলেছেন, এটা বলতেই হবে যে ইরানের সমাজের অধিকতর ধার্মিক অংশ বিয়ে ছাড়া নারী-পুরুষের একসঙ্গে থাকা গ্রহণ করে না। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই ইরানের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধীরে ধীরে ঐতিহ্যগত বিয়ের তুলনায় এটাকেই বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছে। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক এখন আর কোনো ট্যাবু নয়।
ইরানের আইনে বিয়ের বাইরে কোনো নারী-পুরুষের শারীরিক সংস্পর্শ ঘটলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ— যার জন্য ৯৯টি বেত্রাঘাতের মত শাস্তির বিধান রয়েছে। এ কারণে যে যুগলরা এরকম সাদা বিয়ে করেছেন— তারা এটা নানাভাবে গোপন রাখেন যাতে লোকের চোখে তা ধরা না পড়ে।
ইরানের আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মী মেহরাঙ্গিজ কার বলেন, একটা বড় সমস্যা হলো, বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকাটা যেহেতু বেআইনি— তাই কোনো সমস্যা হলে এসব যুগলদের আইনি সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সাদা বিয়ে করেছেন এমন কোনো নারী যদি অত্যাচারিত হন তাহলে তিনি পুলিশের কাছে যেতে পারেন না। কারণ তাহলে তিনি ও তার সঙ্গী উভয়কেই ব্যাভিচারের দায়ে গ্রেপ্তার করা হবে।
ইরানের এলিট সমাজ এসব ‘সাদা বিয়ের’ ফলে জন্ম নেওয়া শিশুদের সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন— কিন্তু তারা এ বিষয়টা নিয়ে খুব কমই প্রকাশ্যে কথা বলেছেন।
এ শতাব্দীর প্রথম দশকেও ইরানে কোন যুবক-যুবতী সাদা বিয়ে করবে এমনটা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন এরকম অবিবাহিত দম্পতির সংখ্যা ক্রমশঃই বাড়ছে।
ইরানের একজন সংস্কারপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য পারবানেহ সালাহশুরি। তিনি গত সেপ্টেম্বরে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, যে নারীরা বিয়ে না করে একসঙ্গে আছেন— তারা গর্ভবতী হলে তাদের সামনে গর্ভপাত ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু সালাহশুরির এই মন্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন দাবি’ বলে আখ্যায়িত করে এর তীব্র সমালোচনা করে ফারস নিউজ এজেন্সি।
ইরানে গর্ভপাত অবৈধ— যদি না নারীর জীবন গর্ভধারণের জন্য ঝুঁকিতে পড়ে বা ভ্রুণের কোনো গুরুতর শারীরিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এসব বিধিনিষেধের কারণে বাজারে গর্ভপাতের বড়ি পাওয়া যায় না এবং অনেক নারীই অবৈধ পন্থায় গর্ভপাত করাতে বাধ্য হন— যা বিপজ্জনক হতে পারে।
ইরানের দেওয়ানি আইনের ১১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, ব্যভিচারের ফলে জন্মানো শিশু ব্যভিচারকারীর হতে পারবে না। এর অর্থ হচ্ছে, সন্তানের বাবা-মা অবিবাহিত হলে তাদের দম্পতি হিসেবে সন্তানকে রাখার কোন অধিকার থাকবে না এবং জন্মনিবন্ধন সনদে শুধু শিশুটির মা তার নাম লিপিবদ্ধ করার অনুরোধ করতে পারবেন।
ইরানের কর্তৃপক্ষ এভাবে জন্মানো শিশুদের একটি গোপন রেকর্ড রাখে এবং এসব তথ্য ভবিষ্যতে তাদের কিছু কিছু চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘লিভ-টুগেদার’ সৌদি আরবে ‘মিসইয়ার’
সৌদিআরবে ক্রমেই চুক্তি ভিত্তিক নামমাত্র বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শর্তহীন এই বিয়ে সৌদি সমাজে ‘মিসইয়ার’ নামে পরিচিত। তবে এই বিয়ে নিয়ে চিন্তিত সৌদির ‘ধর্মীয়’ ব্যক্তিরা। তাদের অভিযোগ ‘মিসইয়ার’-এর মাধ্যমে আদতে উচ্ছৃঙ্খলতাকেই বৈধতা দান করা হচ্ছে।
জানা যায়, মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী বিয়ের আগে সহবাস অবৈধ। তবে এই মিসইয়ারের আড়ালে সৌদি ব্যক্তিরা ‘লিভ-ইন’ বা পরকীয়ায় মেতেছেন। এর জন্যে বিশেষ ‘ম্যাচ-মেকিং’ সাইট বা গ্রুপও আছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
সৌদিআরবে বন্ধনহীন চুক্তি-বিয়ে (মিসইয়ার) বাড়ছে। ‘জাওয়াজ আল মিসইয়ার’ নামে পরিচিত এ বিয়েকে ‘ভ্রমণকারীদের বিয়ে’ও বলা হয়।
স্থানীয় সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে এ বিয়ে প্রচলিত রয়েছে। কোনোরকম আত্মিক বন্ধন ছাড়া এ বিয়ের চুক্তি অনুযায়ী তারা একসঙ্গে থাকতে পারবে।
এর শর্ত অনুযায়ী স্ত্রীর আবাস সংস্থান ও অর্থ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকবেন স্বামী। বিনিময়ে গৃহ রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার ঘরে ঢোকার অনুমতি পাবেন স্বামী। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিয়ের বৈধতা দেওয়ার জন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে চাপ বাড়ছে।
মিসইয়ার বিয়ের শর্তের মধ্যে আরও রয়েছে উভয়ের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নগদ অর্থ। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে এর মেয়াদ। তবে যেকোনো সময়ে উভয়পক্ষ মুসলিম বিয়ের মূল রীতি অনুযায়ী বিয়ে করতে পারবেন। আবার যেকোনো সময় একে অন্যকে ছেড়ে যেতে পারবেন। লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণত এ বিয়ের কথা গোপন রাখা হয়।
জানা যায়, মিসইয়ার প্রকৃতপক্ষে বৈবাহিক সম্পর্ক ও একাকী জীবনের একটা মিশ্রণ। যেখানে বহুগামী নারী-পুরুষ দ্বিতীয় সংসার বয়ে বেড়ানোর চাপ এড়িয়ে বৈবাহিক সম্পর্কের সুবিধা উপভোগ করে থাকেন।
স্থানীয় নাগরিকদের মতো সৌদি আরবে বসবাসকারী প্রবাসী কর্মীরাও এ ধরনের বিয়েতে ঝুঁকছেন বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। নিজেদের পার্টনার খুঁজতে অনলাইনে বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপ ও বিয়ের ঘটকালিতে নিয়োজিত ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হচ্ছেন তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন বিয়েতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকি আছে। তারপরও কিছু নারীর কাছে এই পদ্ধতি পুরুষতান্ত্রিক প্রচলিত বিবাহব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায়। আবার অবিবাহিত দম্পতিরা একে নিজেদের যৌন চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে একধরনের বৈধতার আবরণ হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও ইসলামে বিবাহবহির্ভূত যেকোনো শারীরিক সম্পর্কই নিষিদ্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪২
আপনার মতামত জানানঃ