যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড়শ’ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিল চীন। এটি সামরিক শক্তির নয়, অর্থনীতির। যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে সবথেকে ধনী দেশের তকমা বাগিয়ে নিল চীন।
তবে বেশ আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০১৪ দালের এক জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে চীন ওই সময়ই অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বের এক নম্বর দেশে পরিণত হয়। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের এ উত্তরণ আলোড়ন সৃষ্টি করে বিশ্বজুড়ে।
সূত্র মতে, ১৮৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বিশ্বসেরা অর্থনীতি। এতকাল পরে এসে চীন অদ্যম শক্তিতে সেই শীর্ষস্থান দখল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেলে দিয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে।
সবথেকে ধনী দেশ
গত দুই দশকে বিশ্বে যে পরিমাণ সম্পদ বেড়েছে, তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই চীনের। যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ। নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণাটি করেছে ম্যানেজমেন্ট কানসালটিং ফার্ম ম্যাককিনেসি অ্যান্ড কোম্পানির গবেষণা শাখা। গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল সোমবার ম্যাককিনেসি অ্যান্ড কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
মোট বৈশ্বিক আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি যে ১০টি দেশের দখলে, সেসব দেশের আয়-ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের তালিকা তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই দশকে বিশ্বের সম্পদ বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। আর বৈশ্বিক সম্পদ বৃদ্ধির এ যাত্রায় চীন নেতৃত্ব দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের স্থান নিজেদের দখলে নিয়েছে চীন।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ সালে বিশ্বের নিট সম্পদের মূল্য ছিল ১৫৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ৫১৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এ সময়ে বিশ্বের সম্পদ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই দশকে বিশ্বে যে পরিমাণ সম্পদ বেড়েছে, তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই চীনের। ২০০০ সালে চীনের সম্পদ ছিল সাত ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে এ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের প্রধান প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নিট সম্পদের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বেড়ে তা ৯০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়ায়।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ১০ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদ রয়েছে। এই ধনকুবেরদের সম্পদ দিন দিন বেড়েই চলছে।
চীনের অলৌকিক উত্থান
এক সময়কার খুবই দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশ চীন ৭০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এক অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে গৃহযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর কমিউনিস্ট নেতা চেয়ারম্যান মাও জেদং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার পর থেকে গত সাত দশকে দেশটিতে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে।
নজিরবিহীন সম্পদ অর্জন করেছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। চীন আজ শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেও পরাক্রমশালী এক রাষ্ট্র। সবথেকে ধনী রাষ্ট্র।
গত ৪০ বছরেও বেশি সময় ধরে চীন তাদের বাজার অর্থনীতিতে একের পর এক যুগান্তকারী সংস্কার ঘটিয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্যে নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্রের কবল থেকে বের করে এনেছে।
বিংশ শতাব্দীতে মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ যতো ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ১৯৫০-এর দশককেও বিবেচনা করা হয়। মাও জেদং সেসময় খুব দ্রুত চীনের কৃষি অর্থনীতিকে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার এই কর্মসূচি গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড নামে পরিচিত।
মাও জেদং-এর এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয় এবং ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় এক থেকে চার কোটি মানুষ।
১৯৭৬ সালে মাও জেদং এর মৃত্যুর পর দেং শিয়াওপিং-এর শাসনামলে চীনের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের কাজ আরো বিস্তৃত হতে শুরু করে। নতুন করে গড়ে উঠতে শুরু করে দেশটির অর্থনীতি। কৃষকদেরকে তাদের নিজেদের জমি চাষাবাদের অধিকার দেওয়া হয়। এর ফলে তাদের জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটতে ও খাদ্যের ঘাটতিও কমে আসতে শুরু করে।
বিদেশি বিনিয়োগের জন্যে চীনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে গড়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক। সস্তা শ্রম ও অল্প খরচের কথা মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র সেখানে অর্থ ঢালতে শুরু করে।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে এবং তার পরের সময়ে আমরা দেখি যে বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে চীনের অর্থনীতি এক অলৌকিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৯০-এর পুরো দশক ধরেই চীনে খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। দেশটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয় ২০০১ সালে। চীনের জন্যে এটিও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অন্যান্য দেশের সাথে চীনের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব বাধা ও শুল্ক ছিল সেগুলোও ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যায় যে বিশ্বের সর্বত্র চীনের পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে।
চীন যেন সারা বিশ্বের জন্যে একটি ওয়ার্কশপ বা কারখানায় পরিণত হয়। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে ১৯৭৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার যা ছিল বিশ্ব বাণিজ্য থেকে মাত্র এক শতাংশ কম।
এর পর থেকে চীনের রপ্তানি আরো দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। ১৯৮৫ সালের মধ্যে দেশটির রপ্তানির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে যায় এবং তার দুই দশকেরও কম সময় পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। পণ্য রপ্তানির বিচারে চীন পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম দেশে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ