খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ভারতের ত্রিপুরা পুলিশের রোষানলে পড়তে হল দিল্লির দুই নারী সাংবাদিককে। দুই নারী সাংবাদিক সমৃদ্ধি ও স্বর্ণা ত্রিপুরায় ধর্মীয় ভাঙচুরের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির রিপোর্টিং করছিলেন। তাদের দাবি গোমতি জেলায় একটি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুই নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক সমর্থক এফআইআর দায়ের করে। পরে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের তোপের মুখে পড়া দুই নারী সাংবাদিককে আটক করে পুলিশ। দেশটির ডানপন্থী কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) মামলা দায়েরের পর রোববার তাদের আটক করা হয়েছে বলে খবর দিয়েছে এনডিটিভি।
আসাম পুলিশ রোববার নিলামবাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। এর আগে ত্রিপুরা পুলিশের বিরুদ্ধে হোটেলে এসে ‘ভয়’ দেখানোর অভিযোগ তুলেছিলেন ওই দুই সাংবাদিক।
HW News Network নামে এক সংস্থার ওই দুই প্রতিনিধি ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে সাম্প্রদায়িক অশান্তির চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন। শনিবার স্বর্ণা ঝার নামের ওই নারী সাংবাদিক দাবি করেছিলেন, ত্রিপুরার পানিসাগর এলাকায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা একটি মসজিদ ভেঙে দিয়েছেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ভয় দেখানোরও অভিযোগ করেন তিনি। একইভাবে তার সহকর্মী সমৃদ্ধি সাকুনিয়াও সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে বিস্ফোরক দাবি করেন।
তারপরই ওই দুই নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ত্রিপুরায় একটি এফআইআর দায়ের করেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক কর্মী। তার অভিযোগ ছিল, ওই দুই নারী সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং হানাহানিতে উসকানি দিচ্ছেন। তারপরই ত্রিপুরা পুলিশ ওই দুই নারী সাংবাদিককে নোটিস পাঠায়। এমনকি, রাতে হোটেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করতে যায়। যদিও ওই দুই সাংবাদিক অভিযোগ করেন, তাদের হোটেলে জোর করে আটকে রেখেছিল ত্রিপুরা পুলিশ। আজ সকালে হোটেল থেকে বের হওয়ার অনুমতি পান তারা। কিন্তু আসাম যাওয়ার পথে ওই দুই সাংবাদিককে আটক করে পুলিশ।
ত্রিপুরা পুলিশ বলেছে, সমরুদ্ধি সাকুনিয়ার একটি টুইট ঘিরে মামলা হয়েছে। ওই টুইটে তিনি একটি অর্ধ-পুড়ে যাওয়া বাড়ি পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে কোরআন পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। পুলিশ বলছে, তারা পুড়ে যাওয়া কোনো ধরনের ধর্মীয় নথি পাননি। পরে ওই দুই সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগরতলা থানায় ডাকা হয়। তারা রাজ্য থেকে পালিয়ে যেতে পারেন বলে প্রমাণ পাওয়ার পর তাদের আটক করা হয়।
তবে রোববার সকালের দিকে সাংবাদিক সমরুদ্ধি সাকুনিয়া ও স্বর্ণা ঝা বলেছেন, পুলিশ তাদের ভয়-ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে হোটেল ছেড়ে তাদের আগরতলায় যেতে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন।
সূত্রের বরাত দিয়ে এনডিটিভি বলেছে, পুলিশেরাই দুই সাংবাদিককে একটি নোটিশ পাঠিয়েছিল এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী ২১ নভেম্বর থানায় হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর ঘটনায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ছিল।
সাংবাদিকদের অভিযোগ, তাদের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রশাসনের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করা সত্ত্বেও তাদের যাতায়াত করতে দেওয়া হয়নি। তখন হোটেলের বাইরে ১৬-১৭ জন পুলিশ মোতায়েন ছিল। সমস্যা সমাধানে তিনি আইনি সাহায্য চাইছেন বলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন। তবে তিনি মসজিদ সম্পর্কে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন।
যদিও ত্রিপুরার এক পুলিশ কর্তা জানিয়েছেন, তারা ধর্মনগর মহকুমার একটি হোটেলে থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের অনুমতি নিয়েই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। পুলিশের তরফ থেকে তাদের একটি নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ কর্তারা আরও জানিয়েছেন, নারী সাংবাদিকরা আইনজীবীর সঙ্গে হাজিরা দিতে চেয়েছে বলে তাদের কিছুটা সময়ও দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যে মসজিদের ঘটনা নিয়ে ত্রিপুরায় এত তুলকালাম শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ত্রিপুরার গোমতি জেলার কাকরাবন এলাকায় মসজিদে ভাঙচুর ও হামলার খবর খারিজ করে দিয়েছে। তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ১২টিরও বেশি ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
ভারতীয় এই দুই নারী সাংবাদিক এইচডব্লিউ নিউজ নেটওয়ার্ক নামের একটি গণমাধ্যমে কর্মরত। এইচডব্লিউ নিউজ নেটওয়ার্কের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পুলিশ তাদের হোটেল ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি এবং বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য এক সপ্তাহের কম সময় দেওয়া সত্ত্বেও আটক করেছে। এটি ত্রিপুরা পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নিছক হয়রানি এবং গণমাধ্যমকে টার্গেট করার ঘটনা।
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে ঘটে গিয়েছিল এক দুর্বিষহ ঘটনা। বাংলাদেশের কুমিল্লার দুর্গামণ্ডপে কোরান রাখাকে কেন্দ্র করে দেশের একাধিক দুর্গামণ্ডপে ধার্মিক উন্মাদরা হামলা চালিয়েছিল। একের পর হিন্দু এলাকায় চলেছিল তাণ্ডব। এই অতর্কিত হামলায় প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন। বহু হিন্দুর বাড়ি আগুনে পুড়ে হয়ে গিয়েছে ছাই। আমেরিকা থেকে শুরু করে জাতিসংঘও এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ত্রিপুরায় বেছে বেছে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যারা এই সহিংসতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এবং বিজেপি শাসনাধীন ত্রিপুরা সরকারকে দোষারোপ করেছেন। অথচ যারা সক্রিয়ভাবে সহিংসতায় অংশ নিয়েছে, তাদের ধরা হচ্ছে না বলে মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের একাংশ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে মন্দির ভাঙচুর, হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানোর খবরে উত্তপ্ত হয় ভারত। তার আঁচ এসে লাগে ত্রিপুরায়। সম্প্রতি ত্রিপুরার কয়েকটি মসজিদ এবং মুসলিমদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। রাজ্যজুড়ে সেই হামলায় অন্তত কয়েকটি মসজিদ এবং মুসলিমদের এক ডজনেরও বেশি বাড়িঘর-দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়।
অথচ স্থানীয় পুলিশ বলেছে কিছু হয়নি। আর সেখানকার মিডিয়া নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এই সুযোগে উগ্রবাদী হিন্দুরা একের পর এক মসজিদে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে মুসলিমদের। তাদের বাড়ী-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। শত শত মুসলিম ঘরবাড়ী ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
এত সবের পরেও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নাকি ‘অল ইজ ওয়েল’। পুলিশ তেমনটাই বলেছে। তাদের দাবি, তেমন কিছুই হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
অথচ মানবাধিকার সংগঠন এপিসিআর সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে বলেছে, হিন্দুত্ববাদীরা কমপক্ষে ২৭টি হামলা চালিয়েছিল। ভিএইচপির লোকেরা ১৬টি মসজিদে হামলা চালিয়েছিল। কয়েকটি মসজিদে জোর করে ভিএইচপির পতাকা পুঁতে দেয়া হয়েছিল। কমপক্ষে তিনটি মসজিদে আগুন ধরানো হয়েছিল। উনাকটি জেলার পালবাজার মসজিদ, গোমতী জেলার ডোগরা মসজিদ এবং বিশালগড় জেলার নারোলা টিলা মসজিদে আগুন লাগানো হয়।
স্থানীয় মুসলিমদের অনেকের অভিযোগ, মুসলিমদের ওপর হামলার অভিযোগ দেখেও চুপ করে ছিল সরকার। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা দেখেও একইভাবে চুপ করে ছিল মূলধারার মিডিয়া। এটা আসেল দ্বিচারিতা।
টুইটারে কেউ কেউ অবশ্য অগ্নিদগ্ধ মসজিদের ছবি ও মুসলিমদের বাড়ি ভাঙচুরের ছবি পোস্ট করেছে। হ্যাশট্যাগ সেভ ত্রিপুরা মুসলিম নামে চালানো হয়েছে ক্যাম্পেইনও। অথচ সামনে ভোট, সে কারণেই এমন সহিংতা দেখেও চুপ করে রয়েছে সিপিএমের মতো তথাকথিত দলগুলোও। কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে নিশানা করে বলেছে ত্রিপুরার আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
কিন্তু ত্রিপুরার পুলিশ-প্রশাসন ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা আগাগোড়াই এই সব হামলার কথা অস্বীকার করে আসছিলেন। তারা দাবি করেন, রাজ্যের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার মতো আসলে কিছুই হয়নি।
এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার অভিযোগে ত্রিপুরা রাজ্য পৃলিশ এক শ’র বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি কঠোর সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে পদক্ষেপ নেয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানতে পেরেছে, ত্রিপুরা পুলিশ টুইটারে ৬৮ জন, ফেসবুকে ৩২ জন এবং ইউটিউবে দু্ইজন— মোট ১০২জন অ্যাকাউন্টধারীর বিরুদ্ধে ইউএপিএ নামে ওই কঠোর আইনটি প্রয়োগ করে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচিত সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী আছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ত্রিপুরায় বেছে বেছে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যারা এই সহিংসতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এবং বিজেপি শাসনাধীন ত্রিপুরা সরকারকে দোষারোপ করেছেন। অথচ যারা সক্রিয়ভাবে সহিংসতায় অংশ নিয়েছে, তাদের ধরা হচ্ছে না বলে মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের একাংশ জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতীয় নাগরিকদের বংশধর এবং অভিবাসী— দুই ধরনের মুসলমানরাই ভারতে বসবাস করে। তারা বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় কুসংস্কারের শিকার হচ্ছে। তবুও, মোদি সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে বা তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানাতে অস্বীকার করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে কোথাও সাম্প্রদায়িক হামলা হলে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় কারও মনে হতে পারে যে বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ভারতের সরকার, দূতাবাস। কিন্তু কার্যত তাদের ভূমিকা এ দেশে হিন্দু পরিচয়ের মানুষদের রীতিমতো অপমানিত করে, তাদের নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ায়। এতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং এ দেশে যারা সারাক্ষণ দাবি করে ‘হিন্দুরা ভারতের লোক’, তাদের গলার জোর বাড়ে।
ভারতের বিশেষজ্ঞরাই বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ভারতের বিজেপি সরকারের সে দেশে রাজনৈতিক ফায়দা উঠাতে সাহায্য করে বলেই এ নিয়ে তাদের এত উৎসাহ। তার মানে, বাংলাদেশে যারা ইসলামের নামে মন্দির বা হিন্দুবাড়িতে হামলা করছে, তারা প্রকারান্তরে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেই সহায়তা করছে, ভারতের মুসলমানদের অবস্থা আরও নাজুক করছে। মূলত দুই দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতিই দেশ দুটিতে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ভেদনীতির চিরায়ত এক ভীত গড়ে তুলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৬
আপনার মতামত জানানঃ