দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কোনোভাবেই দমাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। যদিও বিরোধীদলবিহীন নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে দলটির হাইকমান্ড। সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই নির্বাচন থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীরা সরে আসেনি। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মধ্যে ৩৩০টিতেই জয় পেয়েছেন বিদ্রোহী তথা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। শতকরা হিসাবে তা প্রায় ৪০ শতাংশ।
এ ধাপে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা ৪৮৬টি (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৭৮ জন জয়ীসহ) ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। শতকরা হিসাবে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ৫৮ শতাংশ ইউপিতে জয়ী হয়েছেন দ্বিতীয় ধাপে।
এ ধাপে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনের সমন্বিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় ধাপে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৫৯ ভোটারের মধ্যে ১ কোটি ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৩ জন ভোট দিয়েছেন। সে হিসাবে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ী হার বেশি। প্রথম ধাপে ২১ জুনের ভোটে ২০৪টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৪৮ জন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন। ২০ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ১৬০টি ইউপির মধ্যে নৌকার প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচিত হন ১১৯ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ২১ জুনের ভোটে ৪৯ জন এবং ২০ সেপ্টেম্বর জয় পান ৩৬ জন।
সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের ২৬৭ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ৮৫ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। হিসাবে প্রথম ধাপে ৭৩ ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা জয় পেয়েছিলেন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন ২৩ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে।
এর আগে গত ২১ জুন প্রথম ধাপের ২০৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১২০টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়লাভ করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ মনোনীত ২৮ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। আর ৪৯টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
প্রথম ধাপের দ্বিতীয় অংশের ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৩ জন এবং ভোটে ৭৬ জনসহ মোট ১১৯ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়লাভ করেন। মনোনয়নের বাইরে ২৪ জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভের খবর পাওয়া যায়। আগামী ২৮ নভেম্বর ১ হাজার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার দেশের ৬৩টি জেলার ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সাতজন নিহত হন। আহত হন তিন শতাধিক।
ওইদিনই ভোটের পর স্থানীয়ভাবে ফলাফল ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ভোট হওয়া ৮৩৪টির মধ্যে কয়েকটির ফলাফল স্থগিত রয়েছে। সেসব ইউনিয়ন পরিষদের ফলাফল একীভূত করার পর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
নির্বাচনের ফলাফলে বিদ্রোহীদের আধিক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধরণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গণমাধ্যমকে বলেন, শক্তিশালী বিরোধীদল থাকলে বা তারা অংশ নিলে আওয়ামী লীগের এতসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকত না। যেহেতু বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তাই আমাদের দলের অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী নির্বাচনের মাঠে থেকে গেছে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইয়ে ত্রুটি ছিল কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ত্রুটির বিষয় নয়। আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী ও বড় দল। এখানে একই ইউনিয়নে অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকে। তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে যারা শৃঙ্খলা ভেঙে নির্বাচন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে কোথাও কোথাও নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করে এবং জয়লাভ করেন এটা নতুন কিছু নয়। বহু বছর আগে থেকে এটা চলে আসছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়লাভের পেছনে দুটি কারণ দেখা যায়। প্রথমত, স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকলে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয়ভাবে সঠিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে না পারলে।
তারা আরো বলেন, প্রার্থী নির্বাচন করা হয় জেলা-উপজেলার নেতাদের মাধ্যমে। তারা যেভাবে কেন্দ্রে নাম পাঠান, সেখান থেকে মনোনয়ন বোর্ড সিলেকশন করে। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও এমপিদের কাছের লোক মনোনয়ন পেয়ে যায় আবার প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের সুপারিশেও কেউ কেউ পেয়ে থাকে। সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারলে মূলত দল মনোনীত প্রার্থীরা হেরে যায়।
দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মধ্যে ৩৩০টিতেই জয় পেয়েছেন বিদ্রোহী তথা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। শতকরা হিসাবে তা প্রায় ৪০ শতাংশ।
এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭৪ জনের প্রাণ গেছে। গত ১১ দিনে ৭ মৃত্যুও এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন সোমবার, আর পাঁচজন নিহত হয়েছেন গতকাল। আসকের প্রতিবেদনের পরে আরও দুজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, গতকাল মোট প্রাণহানি ঘটেছে ৭ জনের।
স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিক থেকে সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে যে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনার খবর প্রকাশ হয়েছে। এই ঘটনাগুলোতে মোট ৫ হাজার ২৫৪ জন আহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক, ২ জন বিএনপির নেতা-কর্মী এবং একজন সাংবাদিক।
এই সময়ের মধ্যে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন বলে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এছাড়াও, নিহতদের মধ্যে ২২ জন কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।
চলতি বছরের জুনে শুরু হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
বেশিরভাগ প্রাণসংহারকারী ঘটনার জন্যই আওয়ামী লীগের দলীয় অন্তর্কোন্দলকে দায়ী করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করতে হলে দুটি বিষয় আমাদের মাথায় আসে— একটি হলো উৎসব, অন্যটি সহিংসতা। নির্বাচন নিয়ে অতীত স্মৃতি আমাদের যতটা আনন্দের, তার চেয়ে বেশি ভয়ের। এই ভয় হলো নির্বাচনী সহিংসতা। দেশে নির্বাচনী সহিংসতা যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের বিগত প্রায় সব জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলে নির্বাচনী সহিংসতার চিত্র ফুটে ওঠে। এ নির্বাচনী সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সহিংসতা দূর করতে নির্বাচন কমিশন কঠোর হচ্ছে না কেন? নির্বাচনের সময় যেহেতু স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে চলে তাই এই পরিস্থিতির দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তার ওপর। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্য আমাদের নির্বাচনী সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য নির্বাচনী সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তি এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা বলেন, ‘আদর্শিক রাজনীতি এক জিনিস। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি হচ্ছে আদর্শের রাজনীতি। সেই বিষয়টি আলাদা। কিন্তু রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় জমি দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, তাহলে সেটা রাজনীতি হবে না। সেটা হবে রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন। আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি, রাজনীতি হবে নীতির জন্য ও আদর্শের জন্য। রাজনীতি যদি হানাহানির জন্য হয় সেই রাজনীতি প্রত্যাশিত নয়।’
তারা বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শবর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৪
আপনার মতামত জানানঃ