ইউরোপ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্রই কমেছে করোনাভাইরাসের দাপট। ইউরোপে কোভিডে নতুন করে মৃত্যু বেড়েছে। একইভাবে আক্রান্তের সংখ্যাও ঊর্ধ্বগতিতে। টানা ছয় সপ্তাহ ধরে ইউরোপীয় অঞ্চলে করোনার পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘ কয়েক মাসের বিরতি শেষে জার্মানিতে হঠাৎ করেই গত কয়েক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। জার্মানির বিশিষ্ট এক ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বেড়ে চলা করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছেন৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে কমপক্ষে আরো এক লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন তিনি৷
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানাচ্ছে, জার্মানিতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড় সাপ্তাহিক সংক্রমণের হার ২৩২ পেরিয়ে গেছে৷ পরিস্থিতির লাগাতার অবনতির ফলে করোনা টিকা নিতে অনিচ্ছুক মানুষের উপর আরও নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ডাক জোরালো হচ্ছে৷ সেইসঙ্গে হাসপাতালগুলিতে করোনা রোগীর ভিড়ের কারণে গুরুতর অসুস্থ অন্যান্য মানুষের চিকিৎসা ও অপারেশনে বিঘ্ন ঘটায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে৷ দলীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা বর্জন করে গোটা দেশজুড়ে অবিলম্বে অভিন্ন কড়া বিধিনিয়ম চাপানোর দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷
জার্মানির আগামী সরকার গড়ার লক্ষ্যে এসপিডি, এফডিপি ও সবুজ দলের আলোচনা প্রক্রিয়ায় বর্তমান করোনা সংকট সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে৷ বৃহস্পতিবার সংসদে এই তিন দলের সম্মিলিত আইনের খসড়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবার কথা৷ সেই প্রস্তাব অনুযায়ী জার্মানির রাজ্যগুলি ভবিষ্যতেও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনমতো বিধিনিয়ম চালু করার অধিকার পাবে৷ অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর মহামারিজনিত জরুরি অবস্থার মেয়াদ শেষ হলেও আপাতত আরও ছয় মাস বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে৷
ইতোমধ্যেই জার্মানির একের পর এক রাজ্য বদ্ধ জায়গায় শুধু করোনা টিকাপ্রাপ্ত ও করোনাজয়ীদের প্রবেশাধিকারের নিয়ম চালু করেছে৷ অর্থাৎ সুযোগ সত্ত্বেও করোনা টিকা না নেওয়া মানুষের জন্য পরোক্ষ লকডাউন চাপানো হচ্ছে৷ গোটা দেশের জন্য একই নিয়ম চাপানোর আইনি ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় আদালতে সেই নিয়ম বাতিল হতে পারে বলে অনেক রাজনীতিক আশঙ্কা করছেন৷
জার্মানির বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন শীতের মাসগুলির জন্য ভয়াবহ এক পূর্বাভাস দিয়েছেন৷ তার মতে, করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সবার জন্য আবার লকডাউনের প্রয়োজন হতে পারে৷ অবিলম্বে কড়া পদক্ষেপ না নিলে জার্মানিতে করোনার কারণে মৃত্যুর তালিকায় কমপক্ষে আরও এক লাখ মানুষ যোগ হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করছেন৷
ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি এমন ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন৷ যেভাবে হোক, মানুষের মধ্যে যোগাযোগ কমিয়ে মহামারি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি৷ এখনো পর্যন্ত করোনার প্রতিটি ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আনতে একমাত্র সেই হাতিয়ার কাজে লেগেছে৷ নতুন করে সবার জন্য বিনামূল্যে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করেও সংক্রমণের ঢেউ ভাঙা যাবে না বলে তিনি মনে করছেন৷
এ প্রসঙ্গে ড্রস্টেন মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছরের পরিস্থিতি আসলে অনেক বেশি মারাত্মক৷ কারণ করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট করোনা টিকাপ্রাপ্তদেরও সংক্রমণের বাহক করে তুলেছে৷ এমন মানুষ প্রায় কোনো বাধা ছাড়াই সমাজে সবার সঙ্গে মেলামেশা করছেন৷ ফলে ভাইরাস আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং বিশেষ করে সুযোগ সত্ত্বেও টিকা না নেওয়া মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন৷
জার্মানির বিশিষ্ট এক ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বেড়ে চলা করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছেন৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে কমপক্ষে আরো এক লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন তিনি৷
এদিকে জার্মানিতে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনীতি জগতের ‘দুর্বল’ পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে মানুষ আরো জোরালো উদ্যোগের পক্ষে সওয়াল করছেন৷ এক জনমত সমীক্ষায় এমন চিত্র উঠে এসেছে৷ সংবাদ সংস্থা ডিপিএ-র উদ্যোগে পরিচালিত এক জনমত সমীক্ষায় এমন চিত্র ফুটে উঠছে৷
ডয়েচে ভেলে জানায়, প্রায় ৩১ শতাংশ আঞ্চলিক পর্যায়ে এবং ২৫ শতাংশ গোটা দেশে শুধু টিকাপ্রাপ্ত ও করোনাজয়ীদের জন্য রেস্তোরাঁ, সিনেমা বা কনসার্টে প্রবেশাধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷ মাত্র ১৯ শতাংশ করোনা টেস্ট করিয়ে বাকিদেরও সেই সুযোগ দেবার পক্ষে৷ ১৮ শতাংশ করোনা সংক্রান্ত সব বিধিনিয়ম তুলে দেবার পক্ষে সওয়াল করেছেন৷ মোটকথা অস্ট্রিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশ গোটা দেশজুড়ে টিকা না নেওয়া মানুষের প্রবেশাধিকার সঙ্কুচিত করার যে কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জার্মানির বেশিরভাগ মানুষও তেমনটাই চান বলে সমীক্ষায় স্পষ্ট হয়ে গেছে৷
বিভিন্ন মহল থেকে এমন ‘দুর্বল’ পদক্ষেপের সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ বাভেরিয়ার সিএসইউ দল বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে প্রকৃত বিকল্প ছাড়াই জরুরি অবস্থার অবসানের প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেছে৷ বিশেষ করে হাসপাতালের উপর বেড়ে চলা চাপের প্রেক্ষিতে আরও জোরালো পদক্ষেপের ডাক দিচ্ছে এই দল৷ জার্মানির পৌর সংগঠন গোটা দেশে বদ্ধ জায়গায় শুধু টিকাপ্রাপ্ত ও করোনাজয়ীদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছে৷ তাছাড়া অবিলম্বে ফেডারেল ও রাজ্য সরকারগুলির শীর্ষ বৈঠকের ডাক দিয়েছে এই সংগঠন৷
মধ্য ইউরোপের ৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষের দেশ জার্মানিতে গত এপ্রিল মাসে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পার্লামেন্টে নতুন করে সংক্রমণ সুরক্ষা আইন পাস করা হয়। সেই আইনে লকডাউন ব্যবস্থা বহাল, বেশি সংক্রমণের এলাকাগুলোতে রাতে কারফিউসহ স্কুল বন্ধ এবং মানুষের মেলামেশায় কড়াকড়িসহ কঠোর বিধিনিষেধ রাখা হয়েছে। কিন্তু জার্মানিতে বিগত মাসগুলোতে করোনা সংক্রমণ কমে এলে নানা সুরক্ষা আইন শিথিল করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগনিরাময় বিশেষজ্ঞরা আসন্ন বড়দিন উৎসবের আগেই করোনা সংক্রমণে লাগাম টানতে আরও কঠোর সুরক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন। করোনা মহামারির শুরু থেকে জার্মানিতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এই রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, আর মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৯৭ হাজার মানুষের।
গতকাল মঙ্গলবার জার্মানির স্বনামধন্য ভাইরোলজিস্ট ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন বর্তমান পরিস্থিতিতে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি এখনই কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে জার্মানিতে আরও বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে এবং আরও লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। এই বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে খারাপ। কারণ, গত বছর এই সময় কঠোর লকডাউন ছিল।
জার্মানিতে সবার জন্য করোনার টিকার বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন। তিনি বলেন, জার্মানির মোট জনসংখ্যার অর্ধেককেও যদি টিকার বুস্টার ডোজের বিষয়ে উৎসাহিত করা যায়, তাহলে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
গত শনিবার পর্যন্ত জার্মানিতে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ করোনার দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। আর দেশটিতে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ মানুষকে, যা মোট জনসংখ্যার ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ।
ফাইজার–বায়োএনটেকের করোনার টিকার অন্যতম আবিষ্কারক উগুর সাহিন ফ্রাঙ্কফুর্ট রন্ডসুউ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, টিকা দেওয়ার পর সপ্তম, অষ্টম বা নবম মাসে অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে শুরু করে এবং এতে করে করোনার সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবে টিকার বুস্টার ডোজ ভাইরাস প্রতিরোধক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে, যা করোনার ডেলটা ধরনের ক্ষেত্রেও কাজ করে। বুস্টার টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রোগের ভয়াবহতা সাধারণত মাঝারি হয় এবং খুব কম ক্ষেত্রেই গুরুতর অসুস্থতা লক্ষ করা যায়।
জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়ান স্পান সবাইকে টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার পক্ষে বলেছেন। জার্মানিতে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সংগঠন লিওপোল্ডিনা এক বিবৃতিতে বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জার্মানির নীতিনির্ধারকেরা করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের বিষয়ে তেমন প্রস্ততি গ্রহণ করেননি। বিশেষজ্ঞরা টিকা নিতে অনীহা প্রকাশকারীদর বিষয়ে বাধ্যতামূলক টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর তুলনায় জার্মানিতে টিকা দেওয়ার ধীরগতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, জার্মানিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর এটিও একটি কারণ।
দেশটিতে জনসংখ্যা প্রায় ৮৫ মিলিয়নের কাছাকাছি আর টিকা নিয়েছেন ৫৬ মিলিয়নের কিছু বেশি নাগরিক। করোনা অত্মবিশ্বাসী বা টিকা নিতে অনাগ্রহী নাগরিকদের টিকার আওতায় না আনা গেলে সংক্রমণ কখনোই কমানো যাবেনা মনে করছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পাহন। তাই করোনা সংকট মোকাবিলায় সবার সহযোগীতাও কামনা করেন তিনি।
এদিকে বুধবার মহামারী নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউরোপে কোভিডে নতুন করে মৃত্যু বেড়েছে ১০ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে নতুন করে ৩০ লাখের বেশি মানুষ করোনায় শনাক্ত হয়েছেন। গত সপ্তাহের চেয়ে ১ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্বব্যাপী নতুন করে করোনায় ভাইরাসের সবচেয়ে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, তুরস্ক এবং জার্মানি। ইউরোপ ছাড়া অন্যান্য দেশে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ৪ শতাংশ কমেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপীয় অঞ্চলের পরিচারক ডা. হ্যান্স ক্লুগে বলনে, ইউরোপ আবারও মহামারীর কেন্দ্রস্থলে ফিরে এসেছে। সতর্ক করে তিনি বলেন, সংক্রমণ মোকাবিলায় আরও কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়া গেলে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে আরও ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু দেখবে বিশ্ব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ