দেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু এবং পাঁচ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। এছাড়া আহত হয়েছেন ৬১১ জন এবং আরও পাঁচজনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের চার শতাধিক নারী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট ২৫টি জেলায় আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ৩১টি মন্দির ভস্মীভূত করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ২২৭টি পূজামণ্ডপ। ২৪১টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া হিন্দুদের বাড়িঘরে ৭৪৭টি হামলা, ৯৯৪টি প্রতিমা ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা এবং ৩১টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। ১১ হাজার ৫০৭টি হিন্দু পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় আছে। এতে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।
সংগঠনটির অভিযোগ, হামলার প্রতিবাদ করায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭ জনকে ডিজিটাল সিকিউরিটি নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ১৩ অক্টোবর হামলা শুরুর পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হিন্দু মহাজোটের কেন্দ্রীয় কমিটি, নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি ও সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির ৭০ থেকে ৮০ জন সদস্য এসব তথ্য সংগ্রহ করেন। সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। তিনি বলেন, হামলার ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হামলাকারীরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের কারণে প্রশাসন হামলা বন্ধে এগিয়ে আসতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে দুষ্কৃতকারীরা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা অব্যাহত রেখেছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও বরিশালের বামনাকাঠীতে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে।
সংগঠনটি দাবি জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির-বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ৬০টি সংরক্ষিত আসন এবং পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে একজন পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করা হয়। তারা এ ধরনের হামলা বন্ধ করার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও কথা বলেন হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি দীনবন্ধু রায়, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি প্রদীপ কুমার পাল, প্রধান সমন্বয়কারী বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও নারীবিষয়ক সম্পাদক প্রতীভা বাকচী।
হামলার প্রতিবাদ করায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭ জনকে ডিজিটাল সিকিউরিটি নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগ ওঠে, যার জেরে দেশজুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মণ্ডপ, মন্দির, বাড়িঘর এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, এখন তাদের বাংলাদেশে নিরাপদে বসবাস করা বা নিরাপত্তার প্রশ্নে শঙ্কা আরও বেড়েছে।
সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মদদেই হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সরকারের শাসনামলেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, কওমি জননী উপাধি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের তৈরি করা জমিতেই এখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের চাষ হচ্ছে।
তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির পাহারাদার। এদের দিয়ে প্রগতিশীলতা রক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে না। সারা দেশে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা, এর সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা এবং হামলা-লুটপাটের দায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় এর প্রমাণ মিলেছে। নির্বাচিত দল বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঐ সময়ের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় রাজনৈতিক মাঠ গরম থাকে বেশ কিছু দিন। পক্ষে-বিপক্ষে, অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ চলতেই থাকে। সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ রাস্তায় নামে এবং প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করে। তেমন সমাধান পাওয়া যায় না। মামলা হয়; কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও। অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। এবারের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীনদের জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যুদ্ধ করে অর্জন করা। সেই মাটির অধিকার আমাদের সকলের। কেবল ধর্মের কারণে সেই অধিকারবোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এই ঐক্যের বোধ জাগ্রত রাখতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃত সোপান সেখানেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ