সারাদেশে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন সেবা যুক্ত করায় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিকাশের খরচ। ২০১৯ সালের পর থেকে বিকাশের আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ বড়লেও তিন বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠানটি নিট লোকসান গুনছে।
দেশে মোবাইল সেবা প্রদানকারী মাত্র ১৫টি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং সেবা প্রদান করলেও এর বিপরীতে পুরো ব্যাংকিং খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র দুই থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান। তবে সেবাদান ও কার্যক্রমে শীর্ষে বিকাশের অবস্থান।
১০০ শতাংশ লোকসান
সূত্র মতে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে দেশের অন্যতম মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০০ শতাংশ বেশি। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মোট আয়ের পরিমাণ হলো ৪৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও কর পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৫১৯ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি এমএফএস সেবায় গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি হাজার টাকা লেনদেনে সর্বোচ্চ ১৮.৫ টাকা চার্জ আদায় করলেও গত তিন বছর ধরেই প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। গেল বছরের প্রথম নয় মাস (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) লোকসানের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫২ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সমেয় প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ কোটি টাকা।
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ প্রথম থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও ২০১৮ সালের পর আর লাভের মুখ দেখেনি। ওই বছরে বিকাশের নিট ইন্টারেস্ট ইনকাম করেছে ৫৭৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বছরজুড়ে খরচ করেছে ৪১৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে ওই বছরে বিকাশের খরচের পর নিট আয় হয়েছে ৫৩ কোটি টাকা।
এরপর ২০১৯ সালের পর থেকে বিকাশের আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ বড়লেও তিন বছর যাবৎ নিট লোকসান গুনছে। ২০১৯ সালে নিট লোকসান হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২০ সালেও তারা লোকসানের মুখে পড়ে। এদিকে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই প্রতিষ্ঠানটি ১০৪ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে।
একক আধিপত্য স্বত্তেও
বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ১৪১ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। গত আগস্ট মাসের তথ্য অনুযায়ী এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৪৩ লাখ ৬৪ হাজার। এরমধ্যে লেনদেনের দিক থেকে ৬৫ শতাংশ বিকাশ, ১৯ শতাংশ রকেট ও বাকি অংশ অন্যান্য ব্যাংকের দখলে রয়েছে। তবে নগদের লেনদের পরিমাণ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও তাদের লাইসেন্স না থাকায় তথ্য প্রকাশ করছেন না বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেখা যায়, মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানে এখন সবচেয়ে বেশি বাজার বিকাশের দখলে আছে। এর মাধ্যমে সহজে টাকা পাঠানো সুবিধা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইন্টারনেট বিল, সেবামূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার মূল্য পরিশোধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির ৫১ শতাংশ ইকুইটি শেয়ার রয়েছে। বাকি ইকুইটি শেয়ারের মধ্যে ২৯ শতাংশ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত মানি ইন মোশন এলএলসি, ৯.৯ শতাংশ রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং বাকি ১০.১ শতাংশ সিঙ্গাপুরের আলিপের কাছে রয়েছে।
কেন এই লোকসান?
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “দেশের ডিজিটাল সেবায় নতুন নতুন প্রযুক্তি আনতে বিকাশ কৌশলগত কারণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। নতুন এরিয়াতে ডিজিটাল সেবা যুক্ত হচ্ছে, যেখানে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া এজেন্টদের প্রশিক্ষণ, হিউম্যান রিসোর্স, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে তারা। যার কারণে গত কয়েক বছর ধরে লোকসান হচ্ছে।”
তিনি জানান, “যদিও বিনিয়োগকৃত খাতগুলো থেকে ইতোমধ্যে আমরা ভালো ফলাফল পাওয়া শুরু করেছি। আমাদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রবৃদ্ধি হওয়া শুরু করেছে। নিকট সময়ের মধ্যে আমরা ভালো পরিমাণে লাভের মুখ দেখব।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রতি ছয়মাস পরপর প্রতিবেদন প্রকাশ করি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালিকানা স্বচ্ছ। মালিকানায় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকসহ আরও ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান যুক্ত। যারা মালিকানায় রয়েছেন তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো জানেন, আর জেনেই এ খাতে বিনিয়োগ করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠান যে সময়ে লাভ করছিল তারা সে সময়ের লভাংশ না নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। কারণ অল্প সময়ের ব্যবধানে এখান থেকে ভালো লাভের মুখ দেখতে পারবেন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মেজবাউল হক বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠানের ভ্যালুয়েশন করা হয় দুইটি পদ্ধতিতে, একটি আর্নিং ম্যাথোড আরেকটি গ্রোথ মেথোড। আইটি সেক্টরে গ্রোথ দিয়ে হিসাব করা হয়। যে জন্য কোম্পানিগুলোর লোকসান হলেও গ্রোথ ভালো করার জন্য চেষ্টা করে থাকে। কারণ প্রতিষ্ঠনটির গ্রোথ ভালো হলে ভবিষতে এর সুফল পাবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিকাশের প্রতিদিনে গড়ে লেনদেন প্রায় এক কোটির কাছাকাছি। সে বিষয়টি চিন্তা করেই মনে হয় তারা সিস্টেমের উন্নয়নে অধিক বিনিয়োগ করছে। তবে আমরা নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে মন্তব্য করতে পারি না। আমরা সবসময় দেখি গ্রাহকের টাকা কতটুকু সুরক্ষিত রয়েছে এবং তাদের অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য কোথাও যাচ্ছে কি না।”
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৬
আপনার মতামত জানানঃ