স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হচ্ছে ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৬)। এতে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করেছেন স্কটল্যান্ডর উদ্দেশ্যে। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীসহ একটি দল। তবে বিস্ময় এবং একইসাথে দুশ্চিন্তার পারদ চড়িয়ে দেবে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা। অপরাধের চূড়ায় চড়ে বসে দেশটাকে ‘মায়ের’ হাতের মোয়া হিসেবে ভাবা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ ৮ নেতা।
গতকাল শনিবার (৩০ অক্টোবর) রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাবি শাখা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, আজ (৩১ অক্টোবর) থেকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) ২৬তম আয়োজন শুরু হচ্ছে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে। আগামী ১ থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। সম্মেলন শেষে লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হওয়ার কথা আছে। পরে ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বঙ্গবন্ধুর নামে ইউনিসেফ প্রবর্তিত পুরস্কার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অ্যাওয়ার্ড ইন ক্রিয়েটিভ ইকোনমিক্স’ প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স অব পার্টিজের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশন হচ্ছে। এতে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিনিধিদল আজ রবিবার গ্লাসগোর উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
এখানে প্রশ্ন উঠছে ছাত্রলীগের নেতারা কীভাবে এ ধরণের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য বলে বিবেচিত হলো! জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বিশ্বের সবথেকে আলোচিত সমস্যা বলে বিবেচিত। গোটা বিশ্বই এই ঝুঁকিতে আছে। আর গ্লাসগোতে হওয়া এই অধিবেশনকে ধরা হচ্ছে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে। সেখানে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নিয়ে কেন ছাত্রলীগ?
মূলত ছাত্রলীগের কেউ পরিবেশবিদ নয়। সম্ভবত ন্যূনতম ধারণাও তাদের নেই। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কোন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা বা কোন বিশেষ কমিটি কিংবা সংগঠনের সদস্য বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কারও উচিত এই বিষয়টির দেখভাল করা। তাদের মধ্যকার যে কেউ এই অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা রাখে। অথচ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যাচ্ছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ ৮ নেতা; যাদের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমার ধারণা প্রাথমিক বইয়ের জ্ঞানটুকু ছাড়া কিছুই নেই।
যদিও এটা আমাদের নতুন সংস্কৃতি নয়। তাই হয়তো এটাই স্বাভাবিক। প্রায়ই সরকারি কর্মকর্তারা করদাতাদের টাকা নষ্ট করে তাদের পরিবার এবং বন্ধু-স্বজনদের বিদেশে অধিবেশনে নিয়ে যান এবং সরকারিভাবে প্রদত্ত পারিবারিক ছুটি উদযাপন করেন। সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়া বেশিরভাগ প্রকল্পে থাকে বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এ সুযোগটি রাখা হলেও বর্তমানে এটি মূলত প্রমোদ বা বিলাস ভ্রমণে পরিণত হয়েছে। এসব ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান অর্জনের নামে কর্মকর্তারা অনেকেই এমন সব বিষয়ে এমন সব দেশে যান, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাস্যরসের জন্ম দেয়। অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট কারণ আর উপযুক্ত কর্মকর্তা ছাড়া এমন ভ্রমণে শুধু যে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় তা নয়, বরং অপচয় হয় বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থেরও।
অনেকে কর্মকর্তা পরিবার–পরিজন নিয়েও এসব ভ্রমণে বিদেশে যান। যদিও এসব সরকারি সফরের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশের কোনো লাভ হয় না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এটি এক ধরনের আনন্দের উপলক্ষ্য তৈরি করে। অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব ভ্রমণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অকারিগরি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ করিয়ে আনার নজিরও আছে বেশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প তো দূরের কথা অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ করিয়ে আনা হচ্ছে!
সূত্র মতে, প্রায় প্রতিবছরেই সরকারি, আধা–সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। গত ৫ অর্থবছরের হিসাব বলছে, চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া ১ হাজার ৪০৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৯৯৩টিতেই বিদেশ ভ্রমণ ছিল। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানই যৌক্তিকভাবে এ অর্থ খরচ করতে পারে না। যদিও মহামারীকালে সরকারের তরফ থেকে এ অর্থবছরে রুটিন ভ্রমণ পরিহারের পাশাপাশি অপরিহার্য ক্ষেত্রেও সব ধরনের (দেশ–বিদেশ) ভ্রমণ ব্যয় অর্ধেক দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।
এদিকে এই কপ-২৬ অধিবেশনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে; যাতে তারা এ বিষয়ে নিজেদের আরও যোগ্য করে তুলতে পারে এবং জলবায়ুর বিপর্যয় রোধে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারে। তবু ছাত্রলীগ কোনভাবেই এর উপযুক্ত নয়। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের অধিবেশনে যোগ যাওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিলে, তা হতো যথোপযুক্ত। তারা এই ক্রান্তিকালে প্রয়োজনীয় সমাধানের দিকে এগিয়ে নিতে পারতো গোটা দেশটাকে। তবে সরকার বেছে নিয়েছে ছাত্র সংগঠনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ছাত্রলীগকে।
এদিকে, হত্যা ছাড়াও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণসহ আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে৷ শুধু সাধারণ পর্যায়ের কর্মী বা নেতার বিরুদ্ধে নয়, ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ আছে৷ তাই স্বভাবতই ছাত্রলীগ কি সন্ত্রাসীদের সংগঠন- এই প্রশ্ন বেশ পুরনো।
মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়াতেই ছাত্রলীগ নেতারা নির্দ্বিধায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু বুয়েট নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন ছাত্রলীগের টর্চার সেল আছে৷ আসলে এই ছাত্র সংগঠনটি এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে৷ তারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এদের ব্যবহার করছে৷ প্রতিবাদ ও ভিন্নমত দমনের জন্য এদের ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ফলে এই ছাত্র সংগঠনটির সন্ত্রাসই রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এর ফলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছে৷ আর সাধারণ ছাত্ররা তাদের হাতে মারা পড়ছে, নিগৃহীত হচ্ছে৷ এমন একটি সংগঠনের শীর্ষনেতাদের বৈশ্বিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে নিয়ে যাওয়াটা ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় গাধাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সামিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১০২৭
আপনার মতামত জানানঃ