বসতি না বাড়লেও, সেটেলারদের সংখ্যা বাড়বেই। কারণ উচ্চ জন্ম হার। গড়ে ইসরায়েলি নারীদের এখন সাতটির বেশি সন্তান। এমনিতেই ইসরায়েলে জন্ম হার ৩.১। আর দখলকৃত এলাকার বসতিগুলোতে সেটি আরও বেশি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জন্ম হার কম। এর প্রভাব পড়বে মোট জনসংখ্যাতেও।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বন্দ্বের একটি বড় উৎস হলো পশ্চিম তীর কিংবা পূর্ব জেরুজালেমের মতো ফিলিস্তিনি এলাকায় গড়ে ওঠা ইহুদি বসতিগুলো। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কারণে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সময় দখল করা এলাকায় ইসরায়েল তার নাগরিকদের বসতি করতে দিলে সেটি হবে অবৈধ।
তবে আবারও দখল করা পশ্চিম তীরে নতুন করে তিন হাজারের বেশি ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে ইসরায়েল। দেশটির পরিকল্পনা বিষয়ক সরকারি কমিটি ইতিমধ্যে নতুন বসতি স্থাপনের এই পরিকল্পনার বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছে। তবে শুধু বসতি নয়, পশ্চিম তীরে ইহুদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ সেখানে ইসরায়েলি নারীদের সন্তান সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
যদিও সবসময় আলোচনায় থাকে বসতি স্থাপন। এবারও তাই। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান গতকাল বুধবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পশ্চিম তীরে নতুন করে প্রায় তিন হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে ইসরায়েল সরকার। বসতি স্থাপন বিরোধীদের সংগঠন পিস নাও–এর কর্মকর্তা হাগিত ওফরান সংবাদমাধ্যমটিকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েলের বেসরকারি সংবাদমাধ্যম কান পশ্চিম তীরে তিন হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা অনুমোদনের খবর প্রকাশ করেছে। তবে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
গতকাল বুধবার প্রকাশিত বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে নতুন করে প্রায় তিন হাজার ১০০–এর বেশি ইহুদি বসতি স্থাপন করতে চায় ইসরায়েল। দেশটির সরকারি পরিকল্পনা কমিশন ইতিমধ্যে ১ হাজার ৮০০টি বাড়ি নির্মাণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। আরও ১ হাজার ৩৪৪টি বাড়ি নির্মাণের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সরকার গত রোববার দখল করা পশ্চিম তীরে আরও ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়।
ইসরায়েলের গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পশ্চিম তীরে ১ হাজার ৩৫৫টি বাড়ি নির্মাণের জন্য টেন্ডার প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন বসতিগুলোয় দুই হাজারের বেশি বাসিন্দা থাকতে পারবে। গত আগস্টেই পশ্চিম তীরে এসব বসতি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
পশ্চিমতীর থেকেও নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় পশ্চিম তীর দখল করে ইসরায়েল। এর পর থেকে বিভিন্ন দফায় সেখানে বসতি স্থাপন করেছে দেশটি। মূলত ইহুদিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকরের জন্য পশ্চিম তীরে ইহুদিদের উপস্থিতি জোরদার করা জরুরি বলে মনে করেন ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা।
ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা বি’টিসেলেম এর হিসেবে, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ইহুদি বাস করছেন৷ ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিতে যে পরিমাণ বসতি থাকার কথা বলা হয়েছিল এখন সেখানে তার প্রায় তিনগুণ বসতি আছে৷
এদিকে, ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীরকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অংশ মনে করে। কিন্তু ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকেই সেখানে বসতি বাড়াচ্ছে। সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে বহু বসতি স্থাপন করেছে ইসরায়েল। গত বিশ বছরে তাদের জনসংখ্যাও তিনগুন হয়েছে। সেখানে পানি ও বিদ্যুৎ সেবা দিচ্ছে ইসরায়েল। তাদের সুরক্ষা দেয় ইসরায়েলি সেনারা।
২০০৪ সালে গিভাট জাইভ বসতিতে দশ হাজারের মতো মানুষ ছিলো, আর এখন আছে সতের হাজার। এখন পশ্চিম দিকে আরও বাড়ছে। বাড়ছে নতুন বাড়ি, উপাসনালয় ও শপিং সেন্টার। বসতিগুলো নানা আকারের। কিছু আছে যেখানে কয়েকশ মানুষ বাস করে। সবচেয়ে বড়গুলোর একটিতে ৭৩ হাজার ৮০ জন বাস করে। গত পনের বছরে তাদের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে।
তবে চিন্তার বিষয় বসতি না বাড়লেও, সেটেলারদের সংখ্যা বাড়বেই। কারণ উচ্চ জন্ম হার। গড়ে ইসরায়েলি নারীদের এখন সাতটির বেশি সন্তান। এমনিতেই ইসরায়েলে জন্ম হার ৩.১। আর দখলকৃত এলাকার বসতিগুলোতে সেটি আরও বেশি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জন্ম হার কম। এর প্রভাব পড়বে মোট জনসংখ্যাতেও।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে ইসরায়েলিরা পশ্চিম তীরে কেন বসতি করতে চায়। সূত্র মতে, কিছু লোক এসব বসতিতে গেছেন অধিকতর সরকারি সুবিধা পাওয়ার আশায়। কারণ সেখানে ঘরবাড়ি বানানোর খরচ খুব কম। নানা সুবিধার কারণে সেখানকার জীবনমান উন্নত।
আর কিছু মানুষ গেছেন কঠোর ধর্ম বিশ্বাসের কারণে। তারা মনে করেন ঈশ্বর এ জায়গা তাদের জন্য দিয়েছে। তবে এক তৃতীয়াংশই সেখানকার অতিমাত্রায় রক্ষনশীল। তাদের সংসার বড় ও কিছুটা দরিদ্র। আর কিছু আছেন যারা মনে করেন ইহুদিদের প্রাচীন ভূমি হওয়ার কারণে সেখানে তাদেরই বাস করার অধিকার রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি স্থাপনের উদ্যোগের বিরোধিতা করার পর পরই এই পরিকল্পনার কথা জানা গেল।
সম্প্রতি দখল করা পশ্চিম তীরে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপনের ইসরায়েলি পরিকল্পনার ‘তীব্র বিরোধিতা’ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নতুন করে হাজারের বেশি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার। মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলের এমন পরিকল্পনার বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
এই বিষয়ে নেড প্রাইস আরও বলেন, ‘আমরা (মার্কিন প্রশাসন) ইসরায়েলের এমন পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করছি। এই উদ্যোগ ওই অঞ্চলের উত্তেজনা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে অগ্রগতি থমকে যাবে।’
এদিকে, নতুন করে ইহুদি বসতি নির্মাণের ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে ফিলিস্তিনিদের ওপর ‘আগ্রাসন’ বলে বর্ণনা করেছেন ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়াহ। ইসরায়েলি আগ্রাসন ঠেকাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক আইন কি বলছে?
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মতে বসতি অবৈধ। এর ভিত্তি হলো ১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন যাতে দখলীকৃত জায়গায় স্থানান্তরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যদিও ইসরায়েল বলছে এই কনভেনশন পশ্চিম তীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না কারণ তারা সেটি দখল করেনি। তারা কোনো সার্বভৌম শক্তির কাছ থেকে সেটি দখল করেনি।
তাদের দাবি ইহুদি বসতির আইনগত অধিকার ১৯২২ সালে লীগ অব নেশন্সে ফিলিস্তিনের জন্য যে ম্যান্ডেট দেয়া হয়েছিলো সেখানেই আছে যেটি জাতিসংঘ সনদেও সংরক্ষিত।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ