দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। যখন জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব, এমন সময় এসব দুর্যোগের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রায় ৩০০ বছর আগে শিল্পভিত্তিক সভ্যতায় প্রবেশ করেছে মানবজাতি। দিন যত যাচ্ছে, উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া ও মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে কলকারখানা ও শিল্প-প্রযুক্তি নির্ভর। কিন্তু এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প-কলকারখানা ও যানবাহনে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে মানবজাতির সামনে, যার উপসর্গ বা লক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সারা বিশ্ব যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতি নিজের শুশ্রূষা কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। বাধ্য হয়ে আরোপিত লকডাউনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে, কমেছে বায়ুদূষণও। কিন্তু এত সবেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে লকডাউনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের লাভ হলেও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ওপর এর প্রভাব নগণ্য।
ভয়াবহ খরা এবং মারাত্মক বন্যার পাশাপাশি আর্কটিক অঞ্চলের বরফ অস্বাভাবিক হারে গলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তে থাকায় বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও। আগামী কয়েক দশক ধরে এই অবস্থা চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে বিজ্ঞানীরা।
গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশ্বে দেশগুলো। তবে জলবায়ু দূষণ যে গতিতে যেড়ে যাচ্ছে তাতে চলতি শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রিতে পৌছে যেতে পারে। কপ ২৬ জলবায়ু সম্মেলনের আগেই মঙ্গলবার এক রিপোর্টে কঠোর এ সর্তকবার্তা জানিয়েছেন জাতিসংঘ। তাপমাত্রার বৃদ্ধির বিষয়াটিকে ‘বিপর্যয়কর’ বলেও উল্লেখ করেছেন সংস্থাটি।
গ্ল্যাসগোতে আগামী রোববার থেকে জলাবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ-২৬ শুরুর আগে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বার্ষিক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কপ-২৬ সম্মেলন রোববার শুরু হয়ে চলবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত।
সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, জলাবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন কপ-২৬ এ পরিবেশ রক্ষায় নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ১২০টি দেশ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। জাতিসংঘের রিপোর্টেই তা স্পষ্ট।
রিপোর্ট বলছে, বিশ্বজুড়ে দূষণের যে মাত্রা, তাতে এই শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই দশমিক সাত ডিগ্রি বাড়তে পারে। অথচ প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ঠিক হয়েছিল, তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির মধ্যে আটকে রাখতে হবে।
জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, কার্বন ফুটপ্রিন্টই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ। তথ্য দিয়ে তাদের বক্তব্য প্রমাণ করা হয়েছে রিপোর্টে। বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাসের দূষণ সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ কমার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু প্যারিস সম্মেলনে স্থির হয়েছিল তা ৫৫ শতাংশ কমানো হবে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহু দূরে দাঁড়িয়ে আছে দেশগুলো। দ্রুত লক্ষ্যপূরণ করতে না পারলে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া এবং পরিবেশের অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে রিপোর্টে।
বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতে হলে প্রতি বছর গোটা পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ ২৮ গিগাটন কমাতে হবে। অর্থাৎ, প্রতিটি দেশকে বাৎসরিক কার্বন ফুটপ্রিন্ট ৩০ শতাংশ হারে কমাতে হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত সংস্থার প্রধান ইংগার অ্যান্ডারসন বলেছেন, ‘সময় অত্যন্ত দ্রুত চলে যাচ্ছে। হাতে মাত্র আট বছর সময় আছে। এর মধ্যে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়িত করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহতার সামনে দাঁড়াতে হবে বিশ্বকে।’
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রতিটি দেশকে নিজের মতো টার্গেট তৈরি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে যে বিশেষ লাভ হয়নি, তা এখন স্পষ্ট। এর ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দুই দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের সম্মেলনে কড়া ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রতিটি দেশকে নিজের মতো টার্গেট তৈরি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে যে বিশেষ লাভ হয়নি, তা এখন স্পষ্ট। এর ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দুই দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের সম্মেলনে কড়া ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
বস্তুত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গোটা বিশ্বে এবছর তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। দাবানল, তাপপ্রবাহ, বন্যায় ক্ষতি হয়েছে অনেক। আবহাওয়ার খামখেয়ালি রূপ দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে এই সমস্ত বিষয়গুলোকেই আলোচনায় রাখা হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অবশ্য করোনাভাইরাস মহামারি এবং লকডাউনের কারণে গোটা বিশ্বেই আবহাওয়ার সামান্য উন্নতি দেখা গেছিল। কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বেশ খানিকটা কমেছিল। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে সেই গ্রাফ ধরে রাখা যায়নি।
ফের কার্বন নিঃসরণের গ্রাফ ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনের সময়ের গ্রাফ যদি বেধে ফেলা যেত, তাহলে পরিবেশের পক্ষে তা ভালো হতো।
ডব্লিউএমও বলছে, চরম বৈরী আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০২০ সালে এশিয়াজুড়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, লাখ লাখ মানুষ বাস্ত্যুচুত এবং অবকাঠামো ও বাস্ত্যুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।
‘খাদ্য ও পানির নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পরিবেশের অবনতির কারণে টেকসই উন্নয়ন হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।’
প্রতিবেদনে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপদের কারণে মোট বার্ষিক গড় ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। ডব্লিউএমও বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চীনের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপরই ভারত ৮৭ বিলিয়ন, জাপান ৮৩ বিলিয়ন এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত বিষয়কে আমলে নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের তুলনায় মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আনার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তা একেবারেই কম। কিন্তু অভ্যাস ও আচরণগত পরিবর্তনের প্রতিদান এবং কো-বেনিফিটস অনেক বেশী।
তারা বলেন, কভিড-১৯ এর কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। ভেবে দেখা যেতে পারে, কী ধরনের সামাজিক প্রণোদনা মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ