‘বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র। সেই রক্ষণশীল রাষ্ট্রে খালেদা জিয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।’
— মহিউদ্দিন আহমদ।
১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তাধারা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোন অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেতো না। দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার পরামর্শ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে হয়ে ওঠেন বিএনপির সর্বময় কর্তা।
জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হলেন খালেদা জিয়া। তবে আজ মামলায় জর্জরিত বিএনপি। হয়ে পড়েছে নেতৃত্বশূন্য। একদিকে দুর্নীতি মামলায় জেলে আছেন খালেদা জিয়া। বেশ কয়েকটি মামলা এখনও বিচারাধীন। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। যিনি নিজেও দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও বহু মামলায় অভিযুক্ত।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। প্রায় এগার বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেন পথ হারিয়েছে বিএনপি। দমন–নিপীড়নের পাশাপাশি সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে। মামলার বেড়াজালে আবদ্ধ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। লন্ডনে পলাতক যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এমন অবস্থায় দলের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে খোদ বিএনপির হাইকমান্ড।
টালমাটাল বিএনপি
বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং নেতৃত্ব নিয়ে ‘বিএনপি সময় অসময়’ গ্রন্থের লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি জিয়াউর রহমান মারা যাবার পর এবং এরশাদের সময়েও সংকটে পড়েছে। ওয়ান ইলেভেনের সময়েও একটা বড় সংকট তাদের গেছে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি জটিল।
তিনি বলেন, “দলতো আছে, কিন্তু সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে দলের মধ্যে সংহতিটা থাকবে কিনা। কারণ এই দলের অনেক নেতা অতীতে দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আবার এসেছেন, আবার চলেও যেতে পারেন। সরকার থেকে নানান টোপ তাদের দেয়া হতে পারে। সুতরাং এই সময়টা বিএনপির জন্য খুবই নাজুক।”
যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করছেন তাদের নেতা জেলে যাওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ।
ফখরুল বলেন, “মামলা বিএনপিকে বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। কারাগারেও তাকে বেশিদিন রাখতে পারবে না। দল অটুট আছে অটুট থাকবে। মামলা একটা একটা বড় হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগের সরকার। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস আমাদের কর্মীবাহিনী, জনগণ এগুলো উপেক্ষা করে মোকাবেলা করে তারা আমাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য সে লক্ষ্যে তারা পৌঁছুতে পারবে।”
ঘুরে দাঁড়াতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা
আমেরিকার পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে; সেটি এখন বেশ অনিশ্চয়তায় রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এই শিক্ষক এই মুহুর্তে খালেদা জিয়ার ‘খুব ভালো কোন’ রাজনৈতিক ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন না। কারন তাকে মুক্ত করার জন্য বিএনপির তরফ থেকে কোন কার্যকর রাজনৈতিক চাপ বা আন্দোলন দেখা যায়নি।
সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হয়ে সরকারের উপর কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে তার উপর। তার মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যদি বিএনপি কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার কোন রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই।
এদিকে, মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “যেহেতু এই দলগুলো এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক। বিএনপির মতো দলে সেকেন্ড ম্যান বলে কিছু নাই। যাকে তারা সেকেন্ড ম্যান বলছেন তিনিও তো দৃশ্যমান না। সুতরাং এটা আরেক ধরনের সংকট। এবং এই সংকটটা আরো বড় মনে হবে যেহেতু নির্বাচনটা কাছে। সুতরাং নির্বাচনে এবার যদি বিএনপি খুব প্রস্তুতি নিয়ে মোকাবেলা করতে না পারে তাহলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে।”
এদিকে এবছরই বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। গত নির্বাচন বয়কট করা দল বিএনপি এবার যখন নির্বাচন করতে চাইছে তখন দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেন।
মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, “যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এইটা সামাল দেবার জন্য যে ব্যক্তিত্ব, ক্যারিশমা এবং নেতৃত্ব দরকার সেটা কিন্তু দলের মধ্যে বেগম জিয়া ছাড়া আর কারো নাই। দলে যদি নেতৃত্ব না থাকে, দলের পাঁচজন নেতা যদি পাঁচ রকমের কথা বলে, যেটা ইতোমধ্যে আমরা আলামত দেখছি তাহলে তো এই দলটা নির্বাচন করার মতো সামর্থ্য অর্জন করবে না।”
জিয়া পরিবারের বিকল্প!
পতিস্থিতি জটিল হচ্ছে কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার এবং তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে আদালতের রায়ের ওপর। বিরোধী দল ও মতের প্রতি সরকারের কঠোর অবস্থানও স্পষ্ট।
এ অবস্থায় বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নেতৃত্বের কোনো সংকট বিএনপিতে নেই। নতুন কিছু ভাবার কিছু নেই। তিনি বলেন, “আমরা এগুলো নিয়ে এতটুকু চিন্তিত নই শঙ্কিত নই। এটা পার্ট অব পলিটিক্স। যতই ষড়যন্ত্র করা হোক তাদেরকে রাজনীতি থেকে সরানো যাবে না। এটা সম্ভব না।”
তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি একটি পরিবার কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, “পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির সমস্যাটা হচ্ছে এখানে যদি পরিবার থেকে ঐ ধরনের ক্যারিশম্যাটিক লিডার বেরিয়ে না আসেন আরেকজন তখন ঐ রাজনীতি আর টেকে না বেশিদিন।”
তিনি আরও বলেন, “অতীতে আমরা দেখেছি মুসলিম লীগের একই পরিণতি হয়েছে। এছাড়া কৃষক শ্রমিক পার্টি ও ন্যাপের একই পরিণতি হয়েছে।” তার মতে, আমাদের দেশে সামন্ত ধাঁচের মানসিকতা আমরা পরিবারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। জিয়া পরিবার থেকে একটা বিকল্প কাউকে বের করতে হবে।
কারণ পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব তো যাবে না। স্ট্যান্ডিং কমিটির যে অবস্থা কেউ কাউকে মানে না। পরিবার থেকেই কাউকে না কাউকে আসতে হবে। আমরা অনেক গসিপ শুনেছিলাম যে তারেকের স্ত্রী তাকে স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার করা হলো না কেন এটা নিয়ে কয়েকজন কথা বলেছেন। এর বাইরে তো আমি দেখিনা আসলে।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জিয়া পরিবারের বাইরে বিএনপির নেতৃত্ব গেলে দল ভাঙার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানই আগামীতে বিএনপির নেতৃত্বে আসবেন এমন আলোচনা-সমালোচনা দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে হয়েছিল বলে জানা যায়।
বিএনপিতে জাইমা রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে দলের একটি অংশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা দিলেও বিষয়টিকে একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত বলেই মনে করছেন দলের অনেক সিনিয়র নেতা।
তাদের ধারণা, জিয়া পরিবারের গণ্ডির মধ্যে থেকে বের হতে হবে বিএনপিকে। ক্রান্তিকালে দায়িত্ব তুলে দিতে হবে দলের একনিষ্ঠ ত্যাগী নেতাদের। উড়ে এসে দায়িত্ব নিলে সিনিয়ররা নিষ্ক্রিয়ই থেকে যাবে। দলের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না।
২০২৩ নির্বাচন কি কফিনের শেষ পেরেক?
২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশে কমপক্ষে দুই কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। এই নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিএনপি চিত্তাকর্ষক কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের অবদান ও সাফল্যের কথাও বিএনপি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
যেমন স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে বিএনপি একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছে। গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ গঠনে বিএনপি কীভাবে ভূমিকা রেখেছে, তা খাত ধরে ধরে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা যেত। ৫০ বছরে কোন সরকারের আমলে কোথায় দাঁড়িয়েছিল দেশ, এর তুলনামূলক চিত্র নির্মাণ করতে পারত বিএনপি। তথ্যনির্ভর স্মরণিকা প্রকাশ করে বিনা মূল্যে সারা দেশের তরুণদের মধ্যে বিতরণ করা উচিত ছিল। এতে করে নতুন প্রজন্ম বিএনপি, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনকাল সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারত।
বুদ্ধিবৃত্তির স্থবিরতা ছাড়াও বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে খুব বেশি গতি নেই। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে বছরের পর বছর চলে যায়। আহ্বায়ক বা আধাআধি কমিটিগুলোর কোনো জবাবদিহিও নেই। নিজস্ব লোকদের কমিটিতে রাখার প্রবল প্রবণতা নেতাদের মধ্যে বিদ্যমান। বিএনপি এখন ‘আমার’ সংগঠনের পরিণত হয়েছে। সবাই কমিটিতে আমার, মানে নিজের লোকদের রাখতে চায়। কমিটিতে জায়গা না পেয়ে অনেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর দায়িত্বপ্রাপ্তরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না আসার কারণে দলের প্রতি, নেতা-কর্মীদের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতাও অনুভব করেন না। যাবতীয় আনুগত্য নিবেদিত থাকে রাজনৈতিক ভাই বা নেতার প্রতি। এসব কারণে কোন্দল, দলাদলি ও রেষারেষি বিএনপিতে চরম আকার ধারণ করেছে।
এর মধ্যেই ২০২৩ সালে দেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন ঘিরে বিএনপির কোনো নড়াচড়াও গোচরীভূত হচ্ছে না। নিশ্চয়ই বিএনপির নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা জনসাধারণ, ভোটারদের জানাতে হবে। সবটা জানাতে হবে, এমন কোনো কথা নেই; কিন্তু রাজনীতিতে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়ে রাখতে হয়। তবেই না ভোটাররা তাদের প্রতি আস্থা রাখবেন। সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বাধ্য করবেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ