ব্রিটেনে নারীদের টার্গেট করে সুচ ফুটিয়ে হেনস্তা করার প্রবণতা বাড়ছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ তরুণীদের গায়ে ইনজেকশন ফোটানোর ঘটনাটি ব্যাপকভাবে সামনে এসেছে এবং দেখা যাচ্ছে সেখানে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের মেয়েদের সাথে এধরনের ঘটনা ঘটছে। নাইট ক্লাবগুলোতে কিংবা বাইরে ঘুরতে বের হলে তাদেরকে বিপদে ফেলতে গায়ে সুই ফুটিয়ে সটকে পড়ছে আততায়ীরা।
গত সোমবার নটিংহ্যামের একটি নাইটক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীকেও এভাবে সুচ ফোটানোর ঘটনা ঘটেছে।
লিজি উইলসন নামে ওই তরুণী জানান, আচমকা পিঠে সূক্ষ্ম একটা ব্যথা টের পাই। বুঝতে পারি কেউ একজন সুচ বিঁধিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আততায়ী চলে যায় আড়ালে।
তিনি আরো বলেন, মিনিট দশেক পরই টের পাই পা নাড়াতে পারছি না। টলতে টলতে কোনোমতে বন্ধুদের ডাকি। তারাই এগিয়ে এসে উদ্ধার করে আমাকে।
এভাবে তরুণীদের টার্গেট করে ইদানীং ক্লাবগুলোর আশপাশে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে। দ্রুত লিজি উইলসনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে কাউকেই যেনো যেতে না হয়। আমার মনে হচ্ছিল, আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
গত এক বছর ধরেই ব্রিটেনে তরুণীদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। অপহরণ, খুন— এসবই এখন দেশটির বড় ইস্যু। এমনকি বিভিন্ন স্থানে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে। নাইটক্লাব কিংবা রাতে ঘুরতে বের হওয়া উঠতি বয়সী মেয়েদের টার্গেট করে এমন হামলা চালানোর নেপথ্যে কেউ দায়ী করছেন সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা করোনা-পরবর্তী অপসংস্কৃতিকে।
এর আগে কিশোরী ও তরুণীদের গায়ে এভাবে সুচ ফোটানোর বিষয়টি ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখন একই ধরনের ভিকটিমের সংখ্যা বাড়ছেই। শুধু নটিংহ্যাম্পশায়ারেই সম্প্রতি এমন ১২টি ঘটনা ঘটেছে। স্কটল্যান্ডের পুলিশের কাছেও আসছে এমন ঘটনার (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে স্পাইকিং) অভিযোগ।
স্পাইকিংয়ের শিকার তরুণীরা বেশি হলেও, কিছু তরুণও এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন। নটিংহ্যাম্পশায়ার পুলিশ বলছে, ইনজেকশন পুশ করেই সটকে পড়ছে আততায়ী। এখন পর্যন্ত এমন কোনও ঘটনার সঙ্গে কোনও ধরনের যৌন নির্যাতনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। আততায়ীরা মূলত নাইটক্লাবগুলোকে টার্গেট করেই এ কাজটা করছে।
নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন নটিংহ্যাম্পশায়ারের সাবেক পুলিশ প্রধান সু ফিশ। তিনি জানালেন, ‘আচরণের এরচেয়ে অবনতির কথা ভাবা যায় না। এমন ঘটনার শিকড় আরও গভীরে গাঁথা।’
ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুল-এর অধ্যাপক ও সেখানকার অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ফিয়োনা মিশাম জানালেন, “জাতীয় পর্যায়ে প্রতি বছরই কয়েকশ’ স্পাইকিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। এর ঝুঁকি এখনও কম হলেও প্রতিটি অভিযোগকেই গুরুত্ব দিয়ে আলাদাভাবে তদন্ত করতে হবে। আমার মনে হয় এখানে ভীতিটা কাজ করছে বেশি। নাইটক্লাবগুলোর প্রতি ক্ষোভটাও এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।”
দেশটির হোম অ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির প্রধান ইভেট কুপার জানালেন, ‘সমস্যাটার মাত্রা কতটা তা নিয়ে এখনও বাস্তবধর্মী কোনও গবেষণা হয়নি। এখনও এসব ক্ষেত্রে ভিকটিমের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’
তরুণীদের ওপর এমন সহিংসতার প্রেক্ষাপটে দেখা দিয়েছে প্রতিবাদ ও বিতর্ক। ব্রিটিশ তরুণীদের একটি অংশ প্রতিবাদ হিসেবে ক্লাবগুলোকে সাময়িক বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের কথা হলো, ক্লাবগুলোতে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। প্রত্যেককে তল্লাশি করতে হবে। অন্যদিকে কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, রাতে বাইরে বের হলে তরুণীরা যেনও শক্তপোক্ত পোশাক পরে।
এর আগে কিশোরী ও তরুণীদের গায়ে এভাবে সুচ ফোটানোর বিষয়টি ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখন একই ধরনের ভিকটিমের সংখ্যা বাড়ছেই। শুধু নটিংহ্যাম্পশায়ারেই সম্প্রতি এমন ১২টি ঘটনা ঘটেছে। স্কটল্যান্ডের পুলিশের কাছেও আসছে এমন ঘটনার (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে স্পাইকিং) অভিযোগ।
এর প্রতিবাদে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে কয়েকজন তরুণী বলেছেন, ‘আমরা তো আর বর্ম পরে ঘুরে বেড়াতে পারবো না।’ আগে দেখা যেত পানীয়র মধ্যে চেতনানাশক দেওয়া হচ্ছে। তখন কাপ ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হতো তাদের। এখন তো খাঁচায় ঢুকে চলাফেরা করা সম্ভব নয়।
অ্যালি ভ্যালেরো নামের ২০ বছর বয়সী এক তরুণী জানালেন, ক্লাব বর্জনের আহ্বান মানে এই নয় যে আমরা ঘরে বসে থাকতে বলছি। আমরা ক্লাব ম্যানেজারদের বলতে চাচ্ছি তারা যেনও তাদের পরিবেশটাকে আরও নিরাপদ করে।
এদিকে কিছু ইউনিভার্সিটির টুইট নিয়েও খেপেছেন ব্রিটিশ তরুণীরা। সম্প্রতি এক টুইটে ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, তরুণীরা যেনও ইনজেকশন ফোটানোর ঝুঁকিযুক্ত স্থানগুলো এড়িয়ে চলে। প্রতিবাদের তোপে সেই টুইট মুছে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ প্রধান সু ফিশ বললেন, ‘নারীরা অনেক দিন ধরেই এসব মেনে চলছেন। এখন সময় এসেছে পুরুষের আচরণ বদলানোর।’
লন্ডনের একটি পার্কে সম্প্রতি এক স্কুল শিক্ষিকাকে হত্যার ঘটনায় নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে উদ্বেগ বাড়ছে যুক্তরাজ্যে। ছয় মাস আগেও সারা এভারার্ড নামে একজন নারী পুলিশের হাতে খুন হয়েছেন। ফলে লন্ডনের রাস্তায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও গুরুত্ব পাচ্ছে এ বিষয়গুলো।
এক সপ্তাহ আগে সাবিনা নেছা নামের ২৮ বছর বয়সী ওই স্কুলশিক্ষিকা রাতে নিজের বাসা থেকে বের হয়ে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে খুন হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার পরের দিন বিকেলে স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারের কাছে ক্যাটার পার্ক থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ কর্মকর্তারা। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ৩৮ বছর বয়সী একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জো গ্যারিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এ খুনের ঘটনায় সবাই হতভম্ব। প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে আমার সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করছি।
যুক্তরাজ্যে নারীদের প্রতি যে সহিংসতা মহামারি আকার ধারণ করেছে তা বন্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। জানা গেছে এ বছর যুক্তরাজ্যে কমপক্ষে ১০৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যার অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গেই পুরুষরা জড়িত।
গতবছর যুক্তরাজ্যে ১৫ লাখের বেশি নারী অভ্যন্তরীণ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ লাখের বেশি নারী তাদের স্বামী, বয়ফ্রেন্ড,অথবা সাবেক স্বামীর হাতে সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় ৮৮৮ জন নারী তাদের বর্তমান পার্টনারের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, সম্পর্ক ছেদের প্রথম মাসে নিহত হয়েছেন ১৪২ জন নারী।
এক পুলিশ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যখন যুক্তরাজ্যে কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশ দেয়া হয়; এই সময় নারীদের গৃহে হেনস্তা শিকারের মাত্রা ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের পুলিশ ফেডারেশন শুধুমাত্র গত বছরই ১৭ লাখের বেশি নারীর প্রতি অভ্যন্তরীণ সহিংসতার মামলা রেকর্ড করেন। এই সময়ে জাতীয় সহিংসতা হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
যুক্তরাজ্যের নারীদের রক্ষার জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন, নারী এবং স্ত্রী লিঙ্গের মানুষ হত্যার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এমন একটি সংগঠন ‘ফেমিসাইড সেনসাস’ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই দশ বছরে যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৪২৫ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি সংগঠন ‘নিয়া এন্ডিং ভায়োলেন্স’ জানিয়েছে, ২০২১ সালের প্রথম দুই মাসে ২৫ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর জানিয়েছে, স্ত্রী লীঙ্গের মানুষেদের হত্যার সঙ্গে বৈবাহিক অবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। সবথেকে সহিংসতার শিকার হন ২০ থেকে ২৪ বছরের মেয়েরা। আবার বিবাহিত নারীদের থেকে ডিভোর্সড নারীরা বেশি সহিংসতার শিকার হন।
নারীদের নিরাপত্তার জন্য ‘ওয়াক সেইফ’ নামের একটি অ্যাপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এমা কে বলেছেন, মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অনেক নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। যুক্তরাজ্যের নারীরা এখন থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমাদের অবশ্য নিরাপদে রাস্তায় চলতে দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৮
আপনার মতামত জানানঃ