দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই মন্দিরে মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বগুড়া সদর উপজেলায় সর্বজনীন দুর্গামন্দিরে লক্ষ্মী প্রতিমা ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মনসা মন্দিরে তিনটি মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার দিবাগত রাতের আধারে উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের হরিরামপুর গ্রামের মনসা মন্দিরে তিনটি প্রতিমার মাথা ও হাত-পা ভাঙচুর করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
পরের দিন সকালে স্থানীয় লোকজন বিষয়টি দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (সি-সার্কেল) উদয় কুমার সাহা, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ, গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মেহেদী হাসান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম, উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি তনয় কুমার দেব ও সাধারণ সম্পাদক পৌর কমিশনার রিমন তালুকদারসহ পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থলে সিআইডির একটি টিম উপস্থিত হয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে।
স্থানীয়রা জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে সর্বজনীন দুর্গামন্দিরে মঙ্গলবার থেকে পূজা চলছিল। তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী বুধবার পূর্ণিমা তিথি থাকায় রাতে লক্ষ্মী প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে মন্দিরের পাশে পুকুরে লক্ষ্মী প্রতীমা বিসর্জন দেওয়ার কথা ছিল। তবে সকালে স্থানীয় এক মুদিদোকানদার বিপুল দেবনাথ ও কিছু মুরব্বি এসে মন্দিরে প্রতীমা ভাঙচুর অবস্থায় দেখতে পেয়ে ‘৯৯৯’ ও স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে জানান। পরে গতকাল সকালে জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ওই সময় তারা দোষীদের শনাক্তের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানান।
স্থানীয় পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি প্রভাষক দেবাশীষ পোদ্দার জানান, রাতের আধারে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা মনসা মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। তবে এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী সরকার সাজু সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে অতীতকাল থেকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছেন। এখানে অতীতে কখনই এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। এই ঘটনার সঙ্গে যে বা যারাই সম্পৃক্ত থাকনা কেন তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার সি সার্কেল উদয় কুমার সাহা বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
গত ১২ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে কুমিল্লার দিঘীরপাড়ের একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে মূর্তির পায়ের ওপরে কোরআন শরিফ রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন বুধবার সকালে দু’জন ৯৯৯ নম্বরে কল করে অভিযোগ জানালে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টির সত্যতা পায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম পূজামণ্ডপে গিয়ে কোরআন শরিফটি উদ্ধার করেন। মূর্তির পায়ের ওপর থেকে কোরআন উদ্ধারের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে ওইদিন সকাল থেকে বিক্ষুব্ধ জনতা নানুয়ার দিঘীরপাড়ে জড়ো হয়ে মিছিল করে এবং দু’টি মণ্ডপে ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
বুধবার দুপুর ১২টার পর জেলা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। উত্তেজিত জনতা দু’টি মন্দিরে ও একটি পূজার গেটে ভাঙচুর করে। বিকেলে টমছম ব্রিজেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে উত্তেজিত জনতার ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। বিকেল পৌনে ৫টা পর্যন্ত দফায় দফায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও মিছিলের ঘটনা ঘটে। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ১০০ জন আহত হন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর জের ধরে গত কয়েকদিন হবিগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীতে কয়েকটি মন্দিরে ভাঙচুর হয়েছে। সব শেষ রোববার (১৭ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর একটি ফেসবুক পোস্টের জেরে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ১৩ নম্বর রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া-বটতলা ও বড়করিমপুর গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
এ ধরনের ধর্মীয় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন নিন্দা জানাচ্ছে। রাজপথে চলছে প্রতিবাদ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের পূজাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হতে পারে— এটা আগে থেকে আঁচ করতে না পারার বিষয়টি গোয়েন্দা ব্যর্থতা। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না। সাম্প্রদায়িক হামলার কার্যকারণ যা-ই হোক, সহিংসতা মোকাবিলার এই ব্যর্থতার মধ্যেই এই মানবিক বিপর্যয়ের সূত্র খোঁজা চলছে বিভিন্ন মহলে। প্রকাশ্য হামলাকারীদের ঠেকানোয় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা ঘিরেই প্রশ্নগুলো জ্বলন্ত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৪
আপনার মতামত জানানঃ