প্রায় ২০০ বছর আগে সমুদ্রযাত্রায় বেরনোর পর নিখোঁজ হয়ে যায় ব্রিটেনের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। ইউরোপের প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল সম্প্রতি ওই জাহাজের খোঁজ পেয়েছেন বলে জানা যায়। তবে খোঁজ পেয়েও ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে জাহাজটি। কিন্তু কেন?
সূত্র মতে, ইউরোপের দেশ লাটভিয়ার রাজধানী রিগার কাছে দাগ্রিভা সৈকতে খোঁজ মিলেছে এই জাহাজের। জাহাজটি বালিয়াড়িতে ডুবে ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা অবশ্য প্রথমটায় আন্দাজও করতে পারেননি যে একটি গোটা জাহাজ এ ভাবে বালিয়ারির নীচে ২০০ বছর ধরে ডুবে থাকতে পারে। ধ্বংসাবশেষের একটি অংশ দেখে তারা ভেবেছিলেন সেটি কোনও জাহাজের ভাঙা অংশ।
কিন্তু জাহাজের উপর জমা পুরু বালির চাদর সরাতে গিয়ে দেখা যায় ধ্বংসাবশেষের আকার ক্রমেই বাড়ছে। যেটাকে জাহাজের ভাঙা টুকরো ভাবা হয়েছিল যাকে সেটি ক্রমশই একটি পূর্ণ জাহাজের আকার নিচ্ছে।
শেষে দৈর্ঘ্যে ৩৯ ফুট এবং প্রস্থে ১৩ ফুট পর্যন্ত বালির চাদর সরানোর পরও জাহাজের শেষ না দেখতে পাওয়ায় খননের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। দাগ্রিভার সৈকতে পুরনো জাহাজটির উদ্ধারের দায়িত্বে ছিল লাটভিয়ার ন্যাশনাল কালচারাল হেরিটেজ বোর্ড। তারা ঠিক করে, জাহাজটির যতটুকু অংশ খুঁড়ে বার করা হয়েছে, তা নিয়েই গবেষণা হোক। কোথাকার জাহাজ, কী ভাবেই বা বালিয়ারির নীচে এল তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, জাহাজটি ১৮ শতকে তৈরি। সে সময়ে সমুদ্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিল ব্রিটেনের নৌবাহিনী। জাহাজটি তৈরির ধরন এবং জাহাজে ব্যবহৃত ধাতু এবং কাঠের ব্যবহার দেখে তা তৈরির সময়কাল সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন ইতিহাসবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আঠারো থেকে উনিশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত জাহাজে ওক কাঠের বিপুল ব্যবহার করত ব্রিটেনের নৌবাহিনী। প্রতি বছর ৫০ হাজার লোড ওক কাঠ আমদানি করত তারা। স্থানীয় ওক কাঠ ব্যবহার করা হত না, কারণ সেগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত কম লম্বা। বাল্টিক-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে উঁচু একহারা কাঠ আমদানি করত ব্রিটেনের নৌবাহিনী।
আসলে জাহাজের পালের দৈর্ঘ্য উঁচু করাই ছিল লক্ষ্য। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের বেশির ভাগটাই শাসন করত ব্রিটেনের নৌবাহিনী। প্রযুক্তি, আধুনিকতা, কর্মক্ষমতায় তাদের জাহাজ ছিল সেরা। গতি বাড়ানোর জন্য যুদ্ধজাহাজ এবং দূরগামী বাণিজ্য জাহাজে ওক কাঠের মাস্তুল ব্যবহার করা হত।
এক একটি জাহাজ তৈরি হয় প্রায় চার হাজার কাঠের পাটাতন দিয়ে। ঘুন থেকে কাঠ বাঁচাতে মাস্তুল মুড়ে দেওয়া হত তামার পাতে। দাগ্রিভার সৈকতে পাওয়া জাহাজটিও ছিল ওক কাঠে তৈরি। জাহাজের যে অংশ জলের নীচে থাকে, সেই অংশটি থেকে উদ্ধার হয়েছে অসংখ্য তামার পেরেক। যা দেখে ইতিহাসবিদদের অনুমান, ওই কাঠগুলিও তামার পাতে মোড়া ছিল। কেন না ২০০ বছর পরেও জাহাজের কাঠ ছিল যথেষ্ট মজবুত। খুব ভাল ভাবে সংরক্ষণ করা ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।
সেই সময়ে ব্রিটেনের নৌবাহিনীতে নানা আকারের জাহাজ ছিল। যুদ্ধজাহাজে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যার নিরিখে জাহাজের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হত। প্রথম শ্রেণির যুদ্ধজাহাজে ১২০ বা তার বেশি আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। আর সবচেয়ে কম সংখ্যক ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র রাখতেই হত একটি যুদ্ধজাহাজে।
উদ্ধার হওয়া জাহাজটির আকার দেখে তাকে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদরা। তবে কারও মতে এটি দূরপাল্লার বাণিজ্য জাহাজও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাহাজটি থেকে বিপুল অস্ত্র বা সম্পদ উদ্ধারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা।
অবশ্য এত কিছুর জানার পরও জাহাজটি উদ্ধারে আর আগ্রহ দেখাননি লাটভিয়ার ন্যাশনাল কালচারাল হেরিটেজ বোর্ড। জাহাজটি সংরক্ষণ করার জন্য উদ্ধার হওয়া অংশটিকে ফের বালি চাপা দিয়েছেন তারা।
তাদের যুক্তি, এই জাহাজটির গভীরে যে বিপুল ইতিহাস সঞ্চিত আছে তা নিয়ে অকারণ তাড়াহুড়ো করলে ক্ষতির আশঙ্কা আছে। জাহাজের ওই ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার নিয়ে ধৈর্য ধরতে চান তারা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওই জাহাজ এবং সেই সংক্রান্ত ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য এ ব্যাপারে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৭
আপনার মতামত জানানঃ