সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন। বিষয়টি এখন শুধু আলোচনার টেবিলেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন ছাড়িয়ে পড়েছে মাঠ-পর্যায়ে আন্দোলনের মতো।
বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত গ্রিনহাউজ গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। যেটি কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিরতে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। আর জলবায়ুর এহেন পরিবর্তনের মারাত্মক ঝুঁকিতে আফ্রিকার হতদরিদ্র মানুষ।
আফ্রিকায় ১০ কোটির বেশি হতদরিদ্র মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়ছে। আগামী দুই দশকের মধ্যে মহাদেশটির কয়েকটি হিমবাহ গলে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি নতুন প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
মঙ্গলবার বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে আফ্রিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বলা হয়েছে, আফ্রিকায় ক্রমাগতভাবে উষ্ণতা বাড়ার ফলে ১০ কোটির বেশি মানুষ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। মহাদেশটির ৫৪টি দেশ বৈশ্বিকভাবে ৪ শতাংশেরও কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে।
আফ্রিকান ইউনিয়নের গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিবিষয়ক কমিশনার জোসেফা লিওনেল কোরিয়া সাকো বলেন, ধারণা করা হচ্ছে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ২০৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকার প্রায় ১২ কোটি হতদরিদ্র মানুষ খরা, বন্যা এবং প্রচণ্ড উষ্ণতার সম্মুখীন হবে।যাদের আয় দিনে ১.৯০ ডলারের কম তাদের হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সাব-সাহারান আফ্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তন ২০৫০ সালের মধ্যে মোট দেশীয় উৎপাদনকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে মহাদেশটিতে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব পেটেরি তালাস বলেছেন, আফ্রিকাজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এছাড়াও মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে বন্যা, ভূমিধস, খরা।
ধারণা করা হচ্ছে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ২০৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকার প্রায় ১২ কোটি হতদরিদ্র মানুষ খরা, বন্যা এবং প্রচণ্ড উষ্ণতার সম্মুখীন হবে।যাদের আয় দিনে ১.৯০ ডলারের কম তাদের হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা সময়ের একটি সংজ্ঞায়িত সমস্যা। পৃথিবী হুমকির সম্মুখীন এবং মানুষ অদৃশ্য হওয়ার বিপদে! জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দেশ, ধর্ম এবং মতপার্থক্য যাই হোক না কেন লড়াই করার জন্য সবাই একসঙ্গে থাকা আবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিনিয়তই ঘটছে, এমনকি কপ২৫-এ জলবায়ু আলোচনার জন্য বিশ্ব নেতারা বৈঠক করে জানিয়েছেন, ‘আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা থামানোর জন্য যথেষ্ট কিছু করছি না।’ আসলে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
জাতিসংঘ বলছে, আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই পৃথিবী ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি উষ্ণ হওয়ার পথে। পরিবেশদূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরু অঞ্চলে বরফ গলে যাচ্ছে। সমুদ্র ও নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। নিম্নভূমি ডুবে যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে । লাখ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বিপর্যয় শুরু হবে ২০৩০ সালে। এটি ২০৫০ সালে ভয়াবহ আকার নেবে। সেই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চার কোটি মানুষ অভিবাসী হবে। যার অর্ধেক হবে বাংলাদেশি। আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, বিমান ভ্রমণ পরবর্তী ২০ বছরে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আরো ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। ফলস্বরূপ, দুর্যোগ আরো দ্রুত তরান্বিত হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী তিন দশকে ২১৭ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হবে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং বিশ্বজুড়ে সম্পদের বৈষম্য কমাতে জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। প্রতিবেদনে সংকট মোকাবিলায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন কমাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ, অভিবাসনের হার পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৭
আপনার মতামত জানানঃ