ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিলসহ চার আসামির সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। অন্য তিন আসামি হলেন হাঙ্গেরিপ্রবাসী জুলকারনাইন সায়ের খাঁন (সামী), আশিক ইমরান ও ওয়াহিদুন নবী। গতকাল সোমবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এই আদেশ।
সূত্র জানায়, এ মামলায় গত ১২ সেপ্টেম্বর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরসহ সাতজনের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। মামলায় সাত আসামির মধ্যে তিনজন জামিনে আছেন। তারা হলেন আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান। বাকি চার আসামিকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
আসামিদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাতির জনক, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। গত বছরের মে মাসে রমনা থানায় ওই ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। পরে ৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
এজাহারের নথিতে বলা হয়েছে, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। মুশতাক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেছেন।
এছাড়া আসামিরা ‘আই এম বাংলাদেশি’ নামে ফেসবুক পেজে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিয়েছেন, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়।
এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম, আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২০২০ সালের ৫ মে র্যাব-৩-এর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. আবু বকর সিদ্দিক রমনা থানায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, মুশতাক আহমেদ, দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, মিনহাজ মান্নানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
মামলায় তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।
মামলার পর গ্রেপ্তার হয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মিনহাজ মান্নান ও দিদারুল আলম ভূঁইয়া জামিনে মুক্তি পান। কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক কারাগারে ছিলেন। এরপর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মুশতাক কাশিমপুর কারাগারে মারা যান।
এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।
সিপিজে’র এশিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর স্টিভেন বাটলার বলেন, ‘রাজনৈতিক মন্তব্যের কারণে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে বাংলাদেশ সরকার যে আইনি হয়রানি করেছে, তা শিগগির বন্ধ করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। তাদের হয়রানি বন্ধ করা উচিত এবং কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত।’
এ বিষয়ে আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামির মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি স্টেটওয়াচকে বলেছিলেন, ‘বায়বীয় ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট এতটাই একতরফা যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭,০০০ কিলোমিটার দূরে থাকা অবস্থায় কেবল সরকার সংশ্লিষ্টদের সমালোচনা করার জন্যে তার খেসারত হিসেবে আমাকে একটি মামলা খেতে হয়েছে। এটাকে অনেকটা এভাবে তুলনা করা যায়, ধরুন শীতে আপনি কাঁপছেন কিন্তু এক গুরুগম্ভীর ব্যক্তি আপনাকে বললো ওই যে দূরে আগুনটা জ্বলছে তার দিকে তাকিয়ে থাকো গা গরম হয়ে যাবে’!
সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার পরিবার নাকি আজন্ম গনতন্ত্রের চর্চা করে এসেছেন, এই কি সেই গনতন্ত্র যে আপনাদের তিরস্কার করে কার্টুন আঁকলে বা সমালোচনা করলে আপনারা মানুষদের ধরে গুম করবেন? বাগে পেলে পিটিয়ে কান পচাবেন বা জেলে রেখে অত্যাচার করে তিলে তিলে মারবেন’?
স্টেটওয়াচকে তিনি বলেন, ‘কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের দেশের রাস্ট্রপতি ক্ষমা করা দিচ্ছে, এ যেন একটা তামাশা, আপনারা আমাদের দেশ ও জনগনের ভাগ্য নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে যাবেন কিন্তু আপনাদের কিছুই বলা যাবে না! বললেই অত্যাচার, মামলা, গুম বা ক্রস ফায়ারের আদেশ জারী হবে’!
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী স্বৈরাচারীদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে বাংলাদেশীদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলও পারবেনা। কোন মামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা খুনী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে আমাকে বা আমার মত যারা আছেন তাদের রাশ টেনে ধরা যাবেনা’।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, সাংবাদিক সমাজের যারা প্রতিনিধি তারা শুরু থেকেই যে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন সেটা এখন বিবেচনায় নেওয়ার সময় আছে। তা না হলে যেটা হবে এখানে মতপ্রকাশ বলে কিছু থাকবে না।
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ