তালিবানদের যুদ্ধ শেষ। কাবুলের পতন হয়েছে বেশ আগেই। এর মধ্যে তালিবান কয়েকটি দেশের সঙ্গে যতটা পারছে সম্পর্ক পাতানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, তারা আগের মতো নেই, কিছুটা আলাদা। তবে দেশ কীভাবে চলবে, অর্থনীতির কী হবে, সমাজব্যবস্থার কী করবে; এসব নিয়ে আদৌ ক’জন তালিবান ভাবছেন বলা কঠিক। দুয়েকজন ভাবছে, মিটিং করছে সত্য। কিন্তু বেশিরভাগের মাথায় গিজগিজ করছে একটাই চিন্তু- এরপর কাকে বিয়ে করবো!
হ্যাঁ, এটাই এখন আফগানিস্তানের পরিস্থিতি। আফগানিস্তানে গোলাগুলির শব্দ কমে গেলেও দেশটির নারীদের এখনও এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়েই যেতে হচ্ছে। আগেও কমবেশি এ সমস্যায় তারা পড়তেন। ইদানিং তাদের একেবারেই মানুষ বলে মনে করছে না তালিবানরা।
এই যেমন আগস্টের শুরুতে আফগানিস্তানের হেরাত সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন সুমা (ছদ্মনাম)। পাঁচ সন্তানের ভরণপোষণের বিশাল দায়িত্ব তার কাঁধে। স্বামী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। আগস্টের ১৩ তারিখ হেরাতের প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়তেই জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেলো সুমার। ওই দিন হেরাতের যাবতীয় সরকারি কার্যালয় ও থানার দখল নেয় তালিবানরা। চাকরি হারায় সুমা। এদের মধ্যেই এক তালিবান যোদ্ধার নজরে পড়ে যান তিনি।
সুমা বলেন, ‘সে আমাকে হুমকি দিতে শুরু করে। আমি যদি তাকে বিয়ে না করি তবে সে আমাকে ধর্ষণ করবে, আমার সন্তানদেরও মেরে ফেলবে।’ সাক্ষাৎকারে সুমা আরও বলেন, ‘আমার কোনও উপায় ছিল না। সেপ্টেম্বরে কোনও এক মোল্লার অনুমতি নিয়ে ওই তালিবান যোদ্ধা আমাকে জোর করে বিয়ে করে। এরপর থেকে প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত তার কাছে বিভীষিকার মতো কাটছে। ‘আমার কাছে মনে হয় যেনও প্রতিরাতে সে (ওই তালিবান যোদ্ধা) আমাকে ধর্ষণ করছে। মাঝে মাঝে ভাবি আত্মহত্যা করবো। সন্তানদের কথা ভেবে সেটা পারি না।’
গ্রেড ৭ থেকে ১২ পর্যন্ত যারা পড়তো, সেই মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তালিবান। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র বদলানোর চেয়ে তারা এখন অস্ত্র হাতে ঘরে ঘরে গিয়ে উঁকি দিয়ে চলেছে। যাকে ভালো লাগছে তাকে বিয়ে করতেই বেশি মনযোগী তারা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর পর্যবেক্ষণই বলছে, আফগানিস্তানে এখন ‘ফোর্সড ম্যারেজ’ তথা জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। তালোবানদের দাবি হলো, সুমার মতো বিধবাদের জোর করে হলেও বিয়ে করে তারা সমাজের ‘উপকার’ করছে। এ কারণে দেশটিতে যে ২০-৩০ লাখ বিধবা আছেন, তারা প্রত্যেকেই সমান আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কবে না আবার দরজায় রাইফেলের ধাক্কা দিয়ে কেউ বলে ওঠে, উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে!
তালিবানদের ক্ষমতা দখলের আগের মাসেও সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির এক লাখ বিধবাকে মাসে ১০০ ডলার করে ভাতা দেওয়া হত। এখন সেটাও বন্ধ। তারচেয়েও বড় মানবিক বিপর্যয় হলো দেশটির বিধবা বা কিশোরী-তরুণীদের জোর করে বিয়ে করার ‘লাইসেন্স’ দিয়ে দিয়েছেন কিছু কিছু স্থানীয় তালিবান নেতা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে হেরাতের নারীদের আন্দোলনের কথা। যারা কিনা প্রচণ্ড সাহস দেখিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন দুটি মাত্র অধিকার আদায় করতে। প্রথমত, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া চাকরি করার সুযোগ; দ্বিতীয়ত, তাদের কন্যাশিশুদের অন্তত কলেজ পর্যন্ত যেনও পড়তে দেওয়া হয়। যথারীতি এসবে কান না দিয়ে তাদের বেধড়ক পিটিয়ে ও গুলি চালিয়ে হাসপাতালে পাঠায় তালিবান।
বড় পদে থাকা অনেক তালিবান নেতা নিজেদের ইমেজ রক্ষার্থে নারীদের প্রতি ভালো আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে আসলেও অস্ত্রধারী যোদ্ধারা এসব শুনতে নারাজ। এ কারণে তালিবানের বর্তমান শরিয়াহ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে শেষতক একটা বিবৃতিও প্রচার করতে হলো। যাতে তিনি বলেছেন, তালিবান কমান্ডাররা যেনও শুধু শুধু একাধিক বিয়ে না করেন। প্রশ্ন হলো, পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে শীর্ষ নেতারাই এমন বিবৃতি প্রচার করেন?
হাইবাতুল্লাহর একার কথায় কী আর কাজ হবে? তার নিজেরই আছে দুজন স্ত্রী। একাধিক বিয়ের উদাহরণ পাকাপোক্ত করে দিয়ে গেছেন আগের নেতারাও। মোল্লা ওমর থেকে মোল্লা মনসুর, দুজনেরই তিনজন করে স্ত্রী। নতুন উপ-প্রধানমন্ত্রী আবদুল গণি বারাদারেরও আছে তিনজন স্ত্রী। সর্বশেষ বিয়েটা করেছিলেন পাকিস্তানে গৃহবন্দি থাকা অবস্থায়।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে আফগানিস্তানে যতজন আত্মহত্যা করেছিলেন, তাদের ৮০ ভাগই ছিলেন নারী। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েই তারা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনই বলছে, এখনও ৮০ ভাগ আফগান নারী ক্রমাগতভাবে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০১
আপনার মতামত জানানঃ