বার্ধক্য ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন শুধু কিছু সহজ অভ্যাস। এমনটাই বলছেন দুই দশকের ওপর এ বিষয়ে গবেষণা করা জেনেটিক বিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লেয়ার।
ড. সিনক্লেয়ার মনে করেন, এমন দিন খুব দূরে নেই যখন ওষুধের সাহায্যে বার্ধক্য সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এসব ওষুধ এখন পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। তার মতে, এগুলো দিয়ে বুড়ো হওয়ার প্রক্রিয়া আসলেই আটকে রাখা যাবে।
প্রসঙ্গত, বিজ্ঞানী ড. ডেভিড সিনক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। পরবর্তীতে গবেষণা করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একটি ল্যাবরেটোরির প্রধান, যেখানে তার গবেষণার বিষয়, ‘কেন আমরা বুড়ো হই।’
গবেষণার জন্য তিনি বিজ্ঞান জগতের বহু পুরস্কার পেয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকায় তিনি নির্বাচিত একজন ব্যক্তিত্ব এবং টুইটারে তার অনুসারীর সংখ্যা দুই লাখ।
তার ৩৫টি গবেষণার সত্ত্বাধিকারী তিনি নিজে। তিনি বেশ কয়েকটি জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের হয় প্রতিষ্ঠাতা, নয়তো সেগুলোর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকটির কাজের ক্ষেত্র হলো বার্ধক্য বিলম্বিত করা বা ঠেকানো।
মেরিল লিঞ্চ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বার্ধক্য সংক্রান্ত কাজে বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার কোটি ডলার, যা ২০২৫ সালে গিয়ে পৌঁছাবে ৬০ হাজার কোটি ডলারে।
ড. সিনক্লেয়ারের লেখা একটি বই ‘লাইফস্প্যান-হোয়াই উই এজ-অ্যান্ড হোয়াই উই ডোন্ট হ্যাভ টু’ (কেন আমরা বৃদ্ধ হই-আর কেন আমরা বৃদ্ধ হবো না)। বাজারে এখন এই বইটির বেশ চাহিদা রয়েছে। বইটিতে তিনি প্রচলিত বিশ্বাস ভাঙার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন; কেন বার্ধক্য একটা অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া নয়।
ড. সিনক্লেয়ার বিশ্বাস করেন বৃদ্ধ হওয়া নিয়ে যেভাবে আমরা ভাবি, সে ভাবনাতে আমাদের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে, বার্ধক্য একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম নয়। আমাদের এটাকে একটা অসুখ হিসেবে দেখতে হবে। অর্থাৎ রোগ হিসেবে এর চিকিৎসা ও নিরাময় সম্ভব।
তিনি বলছেন, বৃদ্ধ বয়স নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা একেবারে পাল্টে ফেলতে পারি, তাহলে মানব জাতির আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব। অন্যথায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি হয়েছে তার ফলে আমাদের আয়ু আরও বছর দুয়েক হয়তো বাড়ানো যাবে। তবে আমাদের লক্ষ্য এটি আরও অনেক বেশি বাড়ানো।
বিবিসি ব্রাজিলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. সিনক্লেয়ার আমাদের বৃদ্ধ হবার কারণ হিসেবে বলেছেন, বুড়ো হওয়ার নয়টি প্রধান কারণ চিহ্ণিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। গত ২৫ বছরে আমার চালানো গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছি যে, এগুলোর মধ্যে একটি হলো বৃদ্ধ হওয়ার পেছনে অন্য সবগুলো কারণের জন্য দায়ী এবং এর ফলে শরীর তার সব তথ্য হারিয়ে ফেলে।
আমাদের শরীরের দুই ধরনের তথ্য মজুত থাকে। এর মধ্যে এক ধরনের তথ্য আমরা বংশগতভাবে পাই আমাদের মা-বাবার কাছ থেকে। আর অন্য ধরনের তথ্যগুলো শরীরে তৈরি হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত নানা কারণে।
এর একটি হলো ‘ডিজিটাল’ তথ্য। অর্থাৎ যেগুলো জেনেটিক সূত্র এবং অন্যটি হল ‘অ্যানালগ’ তথ্য- যাকে বলা হয় ‘এপিজিনোম’। এটি কোষের ভেতরকার একটা পদ্ধতি। কোন জিন চালু রাখতে হবে, কোনটা বন্ধ করে দিতে হবে সেটা এই পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে।
একটা কোষের ভেতর যে ২০ হাজার জিন থাকে, সেগুলোর মধ্যে কোনটি সক্রিয় থাকবে, আর কোনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, সেটাই কোষটিকে বলে দেয় সে কে- অর্থাৎ ওই কোষের পরিচয় কী হবে এবং কীভাবে সেই কোষটি কাজ করবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই এপিজিনোম পদ্ধতি তথ্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে।
ধরুন ঠিক যেভাবে আপনার গানের একটা সিডিতে আঁচড় লেগে গেলে সিডি সেখান থেকে গানের অংশটা আর খুঁজে বের করতে পারে না। ফলে তথ্যের অভাবে কোষগুলোও ঠিক সময়ে সঠিক জিনকে চালু করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আমার মতে, এ কারণেই আমরা বুড়ো হই।
তিনি মনে করেন আমাদের বৃদ্ধ হওয়ার যুক্তি নেই। তার এই বক্তব্যের পিছনের যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, কারণ জীব বিজ্ঞানে কোথাও লেখা নেই যে আমাদের বুড়ো হতে হবে। আমরা জানি না ঠিক কীভাবে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হয়। যদিও এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার বিষয়টা আমরা ক্রমশ শিখেছি। আমাদের ল্যাবে আমরা বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াটা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। এই প্রক্রিয়া; যেটাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এপিজিনোম বলে- সেটা বদলানো সম্ভব।
যেটাকে আমি সিডিতে আঁচড় লাগার সঙ্গে তুলনা করছি, সেটা আমাদের জীবনকে বিশালভাবে প্রভাবিত করে। আমরা কিছু জিনিস ঠিকভাবে করতে পারলে আমাদের বয়সের ঘড়িটায় জোরেসোরে রাশ টানা সম্ভব। আজকের দিনে এই ঘড়ির দমটা মাপাও যায়- রক্ত ও থুতু পরীক্ষার মাধ্যমে।
আমরা ইঁদুর, এমনকি তিমি, হাতি আর মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছি একেকটা প্রাণীর জীবনযাত্রা একেক রকম। ফলে তাদের প্রত্যেকের বয়স বাড়ে ভিন্ন গতিতে। ভবিষ্যতে আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা কী হবে, তার ৮০ শতাংশের বেশি নির্ভর করে আপনার জীবনযাত্রার ওপর, ডিএনএ-র ওপর নয়।
যারা বহু দিন বাঁচেন, তাদের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। এখানে জীবনযাত্রার মধ্যে রয়েছে আপনি সঠিক খাবার খাচ্ছেন কিনা। যেমন ধরুন ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মানুষ যে ধরনের খাবার খায়, সেটা খুবই ভালো। কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া, বারবার না খাওয়া। শারীরিক ব্যায়ামও সাহায্য করে। অনেকে আবার মনে করে বরফ বা ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করে শরীরের তাপমাত্রা কমানোও উপকারী।
তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জীবনযাত্রার বিভিন্ন অভ্যাস এবং শরীর ভালো রাখতে অভ্যাসের যেসব পরিবর্তন আমরা করি, সেগুলো রোগব্যাধি ও বার্ধক্যের বিরুদ্ধে শরীরের একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। গরম বা ঠাণ্ডা বোধ, ক্ষুধা বোধ, দমের অভাব- এসব অনুভূতি শরীরের এই প্রতিরোধ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে।
এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূলে রয়েছে মাত্র গুটিকয়েক জিন। আমরা এগুলোর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছি। এই জিনগুলো এপিজিনোমকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষুধা ও ব্যায়াম এগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। এ কারণেই আমরা মনে করি, সঠিক খাবার খাওয়া এবং উপোস করা বয়সের ঘড়িকে ধীরে চলতে সাহায্য করতে পারে।
বার্ধক্য বেশিরভাগ রোগের কারণ। এটি হৃদরোগ, স্মৃতিভ্রম ও ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ। কাজেই বার্ধক্য ঠেকাতে পারলে অনেক রোগ ঠেকানো সম্ভব। শরীরে জোর আনা এবং দীর্ঘায়ু হওয়া সম্ভব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪৬
আপনার মতামত জানানঃ