মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষিত হয়। ১৯৬০ সালে মনোচিকিৎসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তার এই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতি ৩৭ হাজারে একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি ১ লাখ ৩ হাজারে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এ সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে প্রতি ৩৪ হাজারে একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে আর অন্যদিকে প্রতি ১ লাখ ৮ হাজারে জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী।
ইউরোপে একসময় জন্মসূত্রে মহিলা হয়েও অনেকেই পুরুষের জীবিকা গ্রহণ করেছেন। শুধু জীবিকাই নয়, কোনো মহিলাকে বিবাহ করে ঘরসংসারও করেছেন। ‘ফিমেল হাসবেন্ড’ ১৮-১৯ শতকের ইউরোপে একটি প্রচলিত শব্দবন্ধ ছিল। তবে তাদের স্ত্রীরা কীভাবে বিষয়টির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন, সেটাই এক রহস্য। অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীরা ছিলেন পিউরিটান খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে। ফলে বিবাহের আগে পুরুষ শরীর সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। পুরুষ এবং নারী শরীরের যে মূলগত পার্থক্য থাকে, তাও জানতেন না অনেকে।
ফলে একজন মহিলাকে স্বামী বলে মেনে নিতে খটকা লাগত না। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রে সেটা হতো না। এক্ষেত্রে একটাই ব্যাখ্যা ছিল। সব জেনেও সঙ্গীর সমস্যাটা বুঝেছিলেন সেই মহিলারা। তাই সমস্ত সামাজিক সংস্কার বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন।
অনেক ক্ষেত্রেই পরিচয় গোপন রাখা সম্ভব হয়নি শেষ পর্যন্ত। আর সেই নামগুলোই থেকে গিয়েছে ইতিহাসের দলিল হয়ে। তার বাইরেও যে সংখ্যাটা নেহাৎ কম ছিল না, সেটা সহজেই বোঝা যায়।
তবে বর্তমানে সমকামীতা-রূপান্তরকামিতার বিরোধীরা প্রায় সবসময়ই একটি কথা বলে থাকেন, এইসবই আধুনিক সমাজের পবিকৃতি। ১০০ বছর আগেও এইসমস্ত বিষয় ছিল না। অথচ পৃথিবীর সমস্ত দেশের উপকথাতেই এমন নানা উল্লেখ পাওয়া যায়, যা থেকে বোঝা যায় প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই মানুষের মধ্যে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার প্রবণতা ছিল।
তবে সেইসব গল্পকথার বাইরে ঐতিহাসিক দলিলও নেহাৎ কম নেই। আর এবার আমেরিকা এবং ইউরোপের ইতিহাস ঘেঁটে এমনই সমস্ত প্রমাণ হাজির করলেন মার্কিন গবেষক জেন ম্যানিয়ন।
তার সাম্প্রতিক বই ‘ফিমেল হাসবেন্ড : আ ট্রান্স হিস্ট্রি’ খুঁজেছে সেইসব দলিল। সেখানেই পূর্বোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন লেখক। জেমস অ্যালেন নামের ওই শ্রমিকের স্ত্রী ছিলেন আবিগেইল নেলর নামের এক মহিলা। ১৮২৯ সালে মৃত্যু হয় জেমস অ্যালেনের।
এই বইতেই রয়েছে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ। সেটিও লন্ডন শহরের। এক বাড়ির মালিকের হঠাৎ সন্দেহ হয়, তিনি যাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন তিনি আসলে পুরুষ নন। সন্দেহ হওয়ায় তিনি স্পষ্ট জানান, কোনো মহিলাকে ঘর ভাড়া দিতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু পুরুষ সেজে থাকা চলবে না। স্যামুয়েল বান্ডি নামের সেই ব্যক্তি নাকি বাড়িওয়ালাকে এক অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিলেন। তিনি আসলে পুরুষই, কিন্তু এক সমুদ্রযাত্রার সময় তার পুরুষাঙ্গটা হাঙরে খেয়ে ফেলেছিল।
অবশ্য এইসব কথায় কোনো কাজ হয়নি। বাড়িওয়ালা ততদিনে সবাইকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচতে লন্ডন ছাড়তে হয় বান্ডিকে। তবে এরপর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সমুদ্র অভিযাত্রী দলের সঙ্গে নানা দেশ ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন স্যামুয়েল। আর এইসমস্ত জায়গায় নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করতে একাধিক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও গড়ে তোলেন স্যামুয়েল। মহিলারাও নাকি তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলেন।
এইসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ অঞ্চলে এক মহিলার সঙ্গে আইনি বিবাহ হয় স্যামুয়েলের। কিন্তু ততদিনে আরও ১২ জন মহিলাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ফলে মামলা গড়ায় নাগরিক আদালতে। সেখানে বিচারের সময় আসল ঘটনা জানা যায়। খবর পেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অসংখ্য মহিলা আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসেছিলেন তাকে। এদিকে অপমানে, লজ্জায় মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন স্যামুয়েলের আইনি স্ত্রী।
উনিশ শতকের প্রথম অর্ধের আরও একটি ঘটনা। লন্ডনের একটি কারখানায় মাথায় কাঠের বোঝা পড়ে মারা গিয়েছেন এক শ্রমিক। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন তাঁর স্ত্রী। করোনার কারখানায় ঢোকার আগে স্ত্রীকে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। কিন্তু মৃতদেহ পরীক্ষা করতে গিয়েই চমকে উঠলেন তিনি। এই শরীর যে আসলে একজন নারীর। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সে-কথা স্পষ্ট করে লিখেও পুরুষ সর্বনাম অর্থাৎ ইংরেজি ‘হি’ শব্দটাই ব্যবহার করলেন করোনার। কারণ তিনি লিখলেন, একজন নারীর যে স্ত্রী থাকতে পারে না।
আঠেরো-উনিশ শতকের নানা ঘটনায় এমন ‘মহিলা গৃহকর্তা’-দের কথা জানা যায়। এইসব প্রমাণ সহজেই বুঝিয়ে দেয়, রূপান্তরকামীরা বরাবরই এই সমাজে উপস্থিত ছিলেন। সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে জন্মগত মহিলারাও পুরুষের জীবন যাপন করেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২৩
আপনার মতামত জানানঃ