আফগানিস্তান অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভাঙনের মুখোমুখি হচ্ছে, যা দেশটিকে মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এরই মধ্যে দেশটির বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আফগানিস্তানে বার্ষিক বিদ্যুৎ চাহিদা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার মাত্র ২২ শতাংশ উৎপাদন হয় আফগানিস্তানের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। এই কেন্দ্রগুলো মূলত জলবিদ্যুৎ, সোলার প্যানেল এবং জীবাশ্ম জ্বালানীভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বাকি ৭৮ শতাংশই আসে প্রতিবেশী দেশ উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরান থেকে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান দা আফগানিস্তান ব্রেশনা শেরকাতের ভারপ্রাপ্ত শীর্ষ নির্বাহী সাইফুল্লাহ আহমদজাই আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ১৫ আগস্ট তালিবান বাহিনী কাবুল দখলের পর থেকে এসব দেশের ডিস্ট্রিবিউটরদের প্রাপ্য বিল পরিশোধ করেনি আফগানিস্তান।
বর্তমানে বকেয়া বিলবাবদ ডিস্ট্রিবিউটরদের পাওনা অর্থের পরিমাণ পৌঁছৈছে প্রায় সাড়ে ৬ কোটিতে, আগামী সপ্তাহে তা আট কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বিল পরিশোধ না করলে যে কোনো দিন ডিস্ট্রিবিউটররা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে বলে শঙ্কা জানিয়েছেন আহমদজাই।
সূত্র মতে, সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রাপ্য বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে ৯ কোটি ডলার সহযোগিতা চেয়ে জাতিসংঘ বরাবর আবেদন করেছে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রায়ত্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি। বুধবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
জাতিসংঘের যে প্রতিনিধি দলটি বর্তামানে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে, তাদেরকে এই সমস্যা জানিয়েছেন উল্লেখ করে আহমদজাই আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘ মিশনের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ব্যাপারটি যেন তাদের মানবিক সহায়তা খাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’
যদিও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল এখনও এই আবেদনে সাড়া দেয়নি। অবশ্য এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে বড় কোনো বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়নি বলেও জানিয়েছেন আহমদজাই। তিনি আরও জানান, আফগানিস্তানের ৩ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার মাত্র ৩৮ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল জমে যাওয়ার প্রধান কারণ ২টি। প্রথমত, তালিবানগোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর বিদেশি ডিস্ট্রিবিউটরদেরকে তাদের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করেনি। এবং দ্বিতীয়ত, তালিবান বাহিনী কাবুল দখলের পর, অর্থাৎ গত ১৫ আগস্টের পর থেকে নাগরিকদের বিদ্যুৎবিলের অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুতের অভাবে যে কোনো দিন অন্ধকার হয়ে যেতে পারে আফগানিস্তান; এমন শঙ্কা অবশ্য তালিবান বাহিনীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। গোষ্ঠীর অন্যতম মুখপাত্র বিলাল কারিমি ফোনে আল জাজিরাকে বলেন, ‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে এবং তারা যে কোনো দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে; এমনটা আমরা আশা করি না।’
বিদ্যুৎ বিভ্রাট আফগানিস্তানের বেশ নিয়মিত একটি সমস্যা এবং তালিবানগোষ্ঠী এই সমস্যার জন্য কিছু অংশে দায়ী। যখন দেশটিতে মার্কিন সমর্থিত সরকার ছিল, সে সময় তালিবান বানিহীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল দেশটির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
এদিকে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফরেন পলিসি প্রধান জোসেফ বোরেল বলেন, আফগানিস্তানে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তালিবানকে শর্ত মেনে চলতে হবে, যাতে তারা আরও বেশি আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে পারে।
এক ব্লগ পোস্টে বোরেল বলেছেন, আফগানিস্তান একটি গুরুতর মানবিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, যা আফগানসহ ওই অঞ্চল এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
গত আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে দেশটিতে খাবার দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার আফগান রিজার্ভ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
বোরেলের তথ্য অনুযায়ী, আফগান ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেকাংশে অচল, মানুষ অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবং শীতের মৌসুম আসতে থাকায় সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
আফগানিস্তানে তালিবান নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ সেখানে মানবিক সহায়তা জোরদার করেছে। তবে সেখানে উন্নয়ন সহায়তা স্থগিত রয়েছে।
বোরেল বলেন, নতুন আফগান কর্তৃপক্ষের আচরণের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করছে। সম্পর্ক আবার ঠিক করতে হলে মানবাধিকারসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯১৬
আপনার মতামত জানানঃ