বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রতিবছরই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অল্প অল্প করে বাড়ছে। পৃথিবীব্যাপি এর প্রভাবের তারতম্য আছে। কোথাও বেশি কোথাও কম। তবে সামুদ্রিক জীব এবং উদ্ভিদ দুটোর উপরেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব অনেক মারাত্মক। এই উষ্ণতার প্রভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সমুদ্রের তলদেশের বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এটি গত ১০ বছরে সমুদ্রের ১৪ শতাংশ ‘সাগর রত্ন’ প্রবাল প্রাচীরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।
সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এই মহামারির কবলে পড়েছে প্রবাল জগৎ। এভাবে উষ্ণতা বাড়তে থাকলে গভীর সমুদ্রের তাৎপর্যপূর্ণ প্রবাল প্রাচীর আরও ক্ষতির মুখে পড়বে। বৈশ্বিক উষ্ণতার এই নেতিবাচক প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে এক গবেষণায়। খবর আল জাজিরার।
গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্কের তিন শতাধিক বিজ্ঞানী প্রবালের আবাসস্থল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার পর মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে ফলাফল প্রকাশ করেন। তারা জানান, উষ্ণতার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া, আরব উপদ্বীপ ও অস্ট্রেলিয়া উপকূল এবং প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, গবেষণায় ৪০ বছরের তথ্য-উপাত্ত, ৭৩টি দেশ এবং ১২ হাজার অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গবেষণার পর যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, ১১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার (৪,৫১৭ মাইল) প্রবাল প্রাচীর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের প্রধান নির্বাহী পল হার্ডিস্টি এক বিবৃতিতে বলেন, পৃথিবীর প্রবাল প্রাচীরের জন্য জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন বড় ধরনের হুমকি।
প্রবাল প্রাচীরগুলো সমুদ্রের তলদেশের মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ জুড়ে রয়েছে, তবে এগুলো সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী এবং উদ্ভিদের কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশের বাসস্থান। নিসর্গের সৌন্দর্যে যেমন ভিন্নমাত্রা যুক্ত করে আণুবীক্ষণিক প্রাণীটি, ঠিক তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা আর সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের খাদ্য হিসেবেও প্রবাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
গবেষণায় ১০টি প্রবাল প্রাচীর নিঃশেষ হওয়ার পেছনে প্রবাল ব্লিচিং, অতিরিক্ত মাছ শিকার, অনুন্নত উপকূল এবং পানির মান রক্ষায় অবহেলা প্রভৃতিকে কারণ বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে ৯০ শতাংশ তাপ সমুদ্র শোষণ করে নেয় এবং যার প্রভাব পড়ে প্রবাল প্রাচীরের ওপর।
প্রবাল প্রাচীর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
প্রবাল প্রাচীরগুলি পৃথিবীর সমুদ্রের তলগুলির প্রায় ২% কভার করে, তবে এই জীবন্ত কাঠামো সমস্ত সামুদ্রিক জীবনের এক চতুর্থাংশ টিকিয়ে রাখার জন্য দায়ী।
একটি প্রতীকী সম্পর্কের ক্ষেত্রে, রিফগুলি ছোট মাছের জন্য প্রতিরক্ষামূলক ঘর এবং তাদের ডিমের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বাসা বেঁধে দেয়। রিফ-বাসকারী মাছগুলি এই সুরক্ষার পক্ষে ফিরে আসে, জীবন্ত প্রবালের জন্য ক্ষতিকারক জীবকে খাওয়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ২৫০ মিলিয়ন বছরের দীর্ঘ সম্পর্কের শক্তি হুমকির মধ্যে রয়েছে। যখন মহাসাগরগুলি খুব উষ্ণ হয়ে ওঠে, চাপযুক্ত প্রবালগুলি তাদের টিস্যুগুলিতে বসবাসকারী রঙিন শেত্তলাগুলি দ্রুত বের করে দেয়, প্রবালগুলি একটি উজ্জ্বল সাদা হয়ে যায়— এটি প্রবাল ব্লিচিং হিসাবে পরিচিত।
একটি সাধারণ ভুল ধারণাটি হ’ল ব্লিচড কোরাল মারা গেছে, তবে এটি সবসময় হয় না। একটি ব্লিচিং ইভেন্ট অনুসরণ করার পরে, প্রবালগুলি শেত্তলাগুলি তার প্রধান খাদ্য উৎস সরবরাহ না করে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাস করে। তারা এ জাতীয় ইভেন্ট থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম, তবে প্রবাল ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রক্রিয়াটি প্রায় ১০ বছর সময় নেয়।
বর্তমানে প্রবাল প্রাচীর নতুন এক বিপদের সম্মুখীন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রী বিরাজ করলেই, এদের উদ্ভিদ কোষের মৃত্যু ঘটে। ফলে, প্রবাল গুলো তাদের রং এবং খাদ্যের প্রধান উত্স হারিয়ে ফেলে। উচ্চ তাপমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি হলে পলিপ গুলো মৃত্যুবরণ করে। বিগত কয়েক বছর, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক প্রবাল প্রাচীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে আক্রান্ত।
এক সময়ের সমৃদ্ধ সামুদ্রিক রাজ্যগুলি পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। ফলে ,এসব প্রাচীরে বসবাস করা প্রাণীগুলো হয়ে পড়েছে গৃহহীন।
কিছু বিজ্ঞানীদের মতে চলতি শতাব্দীর মধ্যেই পৃথিবীর সকল প্রবাল প্রাচীর এর অস্তিত্ব বিলীন হবে।
প্রায় ১০০ কোটি মানুষ খাদ্য ও জীবিকার জন্য প্রবাল প্রাচীরের উপর নির্ভরশীল। ক্যান্সার চিকিত্সায় ব্যবহৃত প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ও ব্রাওস্টার্টিন নামক দুটি ওষুধ আসে প্রবাল থেকেই। ফলে প্রবাল প্রাচীর বিলুপ্ত হলে কোটি কোটি মানুষ জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
বছরের বিশেষ একটি পূর্ণিমার রাতে পূর্ণ চাঁদ এক নান্দনিক ঘটনা ঘটায়। অসাধারণ ছন্দে পুরো কলোনি বংশ বিস্তার করে। প্রবালের লক্ষ কোটি স্পোর সমুদ্রে ছড়িয়ে যায় এবং স্রোতের সাথে দূর দূরান্তে পাড়ি জমায়। প্রবাল প্রাচীরের একটি তরুণ দল অজানা সমুদ্রে পাড়ি দেয়।
অনেক আগ থেকেই নানান রোগ সারার জন্য মানুষ প্রবাল পাথর ধারণ করত। তবে বর্তমানে আধুনিক অনেক ওষুধে প্রবালের ব্যবহার রয়েছে। এটি ক্যান্সার ও এইডসের প্রতিষেধকে রাসায়নিক উপাদান হিসেবে খুব ব্যবহৃত হয়। মানুষের হাড় ভাঙার চিকিৎসায় বোন গ্রাফটিংয়ে প্রবালের কঙ্কাল ব্যবহৃত হয়। অনেক এলাকায় কন্সট্রাকশনের কাজেও প্রবাল ব্যবহৃত হয়। একুয়াকালচারেও প্রবালের চাহিদা রয়েছে।
বলা বাহুল্য, সাগরের সৌন্দর্য এবং মানুষের ব্যবহারিক জীবনে কোরালের ভূমিকা অপরিসীম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মানুষের কিছু কর্মকাণ্ড এবং দূষণের কারণে ধীরে ধীরে এ ‘সাগর রত্ন’ হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুক থেকে। তাই একে রক্ষা করা না গেলে সেটি হবে প্রকৃতির জন্য মারাত্মক এক ক্ষতিকর। তাই প্রবাল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৮
আপনার মতামত জানানঃ