মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদ এর মাধ্যমে দেওয়া ভাতা ও উপবিত্তির টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের ভাতার টাকা এবং উপবিত্তির টাকা ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে লক্ষাধিক গ্রাহক। নগদ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের গড়িমসির কারণে শহর ও গ্রামাঞ্চলের শত শত বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে হা-হুতাশ বাড়ছে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বাথপুকুরিয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তির বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা নগদ একাউন্ট থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। টাকা উদ্ধারের জন্য তারা শনিবার ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশের দারস্থ হন। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেয়েছে।
ভাতাভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় সাগান্না ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুল ওহাবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজন নামে এক কলেজছাত্র এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। ডাকবাংলা বাজারের নগদ’র এজেন্ট হবিবুর রহমানও স্বীকার করেছেন রাজন মাঝেমধ্যে এসে ভাতাভোগীদের টাকা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মাখন বিশ্বাস জানান, ভাতাভোগী নুরুল ইসলাম, ফেরদৌসি খাতুন, নুর আলম ও বাবুল হোসেন টাকা না পেয়ে থানায় অভিযোগ করেন। তিনি সরেজমিন তদন্ত করে দেখেছেন বাথপুকুরিয়া গ্রামের প্রায় ৬/৭ জন বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাদের ভাতার টাকা পাননি। বিষয়টি প্রযুক্তিগত ও জটিল হওয়ায় তিনি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে ভুক্তভোগীদের শনিবার থানায় ডেকে তাদের বক্তব্য শোনেন। ভাতাভোগীরা ইউপি মেম্বরের সহযোগী বাথপুকুরিয়া গ্রামের শাহিন মিয়ার ছেলে রাজনকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তিসহ সরকারি বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) ‘নগদ’ সরাসরি উপকারভোগীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। ‘নগদ’-এর তথ্য থেকে জানা যায়, ‘চলতি বছরে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এমএফএস অপারেটরদের মাধ্যমে পাঁচ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা বিতরণ করেছে, যেখানে মোট ৭৫ শতাংশ ভাতা স্বচ্ছতার সঙ্গে বিতরণ করেছে নগদ।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ এপ্রিল মাসে ঝিনাইদহে প্রাইমারি স্কুলের প্রায় শাতাধিক শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়। সেই টাকা আজো উদ্ধার হয়নি। শনাক্ত করা যায়নি প্রতারক চক্রকে। এরই মধ্যে এই প্রতারকচক্রের আবার নজর পড়েছে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রদেয় অন্যান্য শিক্ষা উপবৃত্তি, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার উপর।
শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের হাসি রানীর অভিযোগ, তিনি নতুন ভাতাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু প্রথম কিস্তির টাকা তিনি পাননি। নগদ অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখেন তার টাকা কে বা কারা হ্যাক করে তুলে নিয়েছে।
তার মতো অনেকের টাকা হ্যাক করে উঠিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের সদস্য অনিতা বিশ্বাস।
ঝিনাইদহ পৌর এলাকার কালিকাপুর গ্রামের ফারজানা আফরিন অ্যানী জানান, অহসায় প্রতিবন্ধী হিসেবে তিনি প্রতিমাসে ভাতা পেয়ে আসছেন। তিনি নগদ অ্যাকাউন্ট খোলার পর সাড়ে চার হাজার টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা আসে। কিন্তু সেই টাকা গত ৯ জুলাই কে বা কারা ট্রান্সফার করে নেয়। এ ঘটনায় তিনি ১৯ আগস্ট ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি জিডি করেছেন। কিন্তু এখনো টাকা ফিরে পাননি।
ঝিনাইদহের ছয় উপজেলায় এভাবে শত শত নগদ অ্যাকাউন্ট নম্বর হ্যাক করে উপবৃত্তি, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা জেলা থেকে এ রকম শত শত অভিযোগ পাচ্ছি, কিন্তু তাদের কোনো সহায়তা দিতে পারছি না।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহে শত শত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির টাকা ‘নগদ’ একাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে। একাউন্ট হ্যাক করে কে বা কারা হতদরিদ্রদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তার রহস্য এখনো সমাজসেবা অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। টাকার শোকে হতদরিদ্ররা আহাজারি করলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল সামি জানান, সারা জেলা থেকে কত জনের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হ্যাক করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাড়া মহল্লার ১৩৬ জন বয়স্ক, চারজন বিধবা, ২৩ জন প্রতিবন্ধী ও চারজনের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা তাদের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৪৭ লাখ বলে তিনি জানান।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা জেলা থেকে এ রকম শত শত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তাদেরকে কোন সহায়তা দিতে পারছে না তারা। কোনো কোনো উপজেলায় ৫% থেকে ১০% টাকা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে। ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাড়া মহল্লার ১৩৬ জন বয়স্ক, ৪ জন বিধবা, ২৩ জন প্রতিবন্ধী ও ৪ জনের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা তাদের নগদ একাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়। এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৪৭ লাখ। অনেক ভাতাভোগীর একাউন্ট খোলার আগেই টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
জেলা সমাজসেবা অফিসের হিসাবমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে চতুর্থ কিস্তির টাকা শৈলকুপায় ১২ জনের, সদর উপজেলায় ১৭ জনের, কালীগঞ্জে ৭ জনের, হরিণাকুন্ডুতে ১৪ জনের ও ঝিনাইদহ পৌরসভায় ১৫২ জনের উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় কিস্তির টাকা শৈলকুপায় ১৪ জনের, কোটচাঁদপুরে ৫ জনের, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ১৮ জনের, মহেশপুর উপজেলায় ১৫৯ জনের, কালীগঞ্জে ২৮ জনের ও হরিণাকুন্ডুতে ৪৯ জনের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ জানান, নগদ একাউন্ট খোলার পর নগদ কর্মীদের দেয়া গোপন পিন নাম্বার দিয়ে অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারেনি ভাতাভোগীরা। সমাজসেবা থেকে এমন অভিযোগ অধিদপ্তরে দিলে সব গোপন পিন ‘অটো রিসেট’ করে দেয়া হয়। পরে ভাতাভোগীরা গোপন পিন রিসেট করে দেখেন তাদের অ্যাকাউন্টের টাকা আগেই তুলে নেয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ঝিনাইদহ থেকে ঠিক কত জনের টাকা নগদ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তুলে নেয়া হয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে এক হাজার ভাতাভোগীকে শনাক্ত করতে পেরেছি। তাদের তালিকা সমাজসেবা অধিদপ্তরকে দিয়েছি। সেখান থেকে নগদ কর্তৃপক্ষের কাছে গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা প্রকৃত প্রতিবন্ধী, তারা প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার হকদার। এটাই নিয়ম। কিন্তু প্রায়ই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে থাকে। ফলে যে উদ্দেশ্যে সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এসব ভাতা চালু করেছিল, সেই উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। এবিষয়ে সরকার ও প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। ভুক্তভোগীদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৮
আপনার মতামত জানানঃ