ধূমপান বা তামাক সেবন বহু রোগের আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে, কোটি মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে যদি একটিমাত্র বিষয়কে নিষিদ্ধ করতে হয়, তা হলো তামাক। আরও ভালো করে বললে সিগারেট। সংস্থাটির তথ্যমতে, পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ ধূমপায়ীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রতিবছর অন্তত ৭০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ধূমপানের কারণে মারা যাচ্ছে। আর পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মারা যাচ্ছে আরও ১০ লাখ।
তামাক সেবনের সবচেয়ে প্রচলিত রূপটি হচ্ছে সিগারেট। এতে তামাকের প্রধান উপাদান নিকোটিন ছাড়াও রয়েছে প্রায় ৭ হাজার রাসায়নিক। এর মধ্যে অন্তত ৭০টি রাসায়নিককে মানুষের জন্য চরম ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে ধূমপানের ইতিহাস সভ্যতার মতোই প্রাচীন। সেই প্রাচীন কালেই ব্যাবেলনীয় ও মিশরীয়দের মধ্যে ধূমপানের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে প্রাচীন মিশরীয়রা ‘ক্যানাবিস’ নামক ধূমপানের প্রচলন করেছিল। যা ছিল আদতে আমাদের দেশের হুক্কার একটি রূপ।
১৬ শতকে আমেরিকাতে প্রথম তামাকের চাষ শুরু হয়। ১৮৬৫ সালে ওয়াশিংটন ডিউক নামে আমেরিকার এক ব্যক্তি প্রথম হাতে তৈরি সিগারেট উদ্ভাবন করে। পরে ১৮৮৩ সালে জেমস বনস্যাক নামে আর এক আমেরিকান সিগারেট তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করে। যা থেকে দিনে প্রায় এক হাজার সিগারেট তৈরি করা যেত।
তবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাই হল তামাক গাছের জন্মস্থান। ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময়কালে তামাক গাছের অস্তিত্বের কিছু নমুনাও পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। জানা যায়, দাঁতের ব্যথা কমাতে বা কাটাছেঁড়ার ওষুধ হিসেবে সে সময় তামাক পাতা ব্যবহার করা হত আমেরিকায়।
তবে তামাক পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া টানার প্রচলন হয় ষোড়শ শতকের কিছু আগে থেকে। ১৫৮৮ সালে ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা টমাস হ্যারিয়েট তামাক পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া টানার প্রচলন করেন।। গ্যালিলিওর আগে এই টমাস হ্যারিয়েটই প্রথম টেলিস্কোপে দেখে চাঁদের ছবি এঁকেছিলেন। শোনা যায়, এই হ্যারিয়েটের হাত ধরেই আলুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে ব্রিটিশদের।
যাই হোক, তামাকের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমেরিকায় গিয়ে টমাসের ধারণা হয়েছিল, নানা রোগ আটকাতে পারে তামাকের ধোঁয়া। আর সে জন্যই তিনি তামাক পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া টানার প্রচলন করেন। ২ জুলাই, ১৬২১ সালে ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে টমাস হ্যারিয়েটের মৃত্যু হয়।
অনেকের ধারণা, অতিরিক্ত তামাক সেবনই হ্যারিয়েটের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পর তামাকের চাহিদা এতটাই বৃদ্ধি পায়, যে ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু দেশে একটা সময় স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে তামাক পাতা দিয়ে বেচাকেনা শুরু হয়েছিল।
এর অনেক পরে ১৯০২ সালে শুরু হয় বিশ্ববিখ্যাত সিগারেট প্রস্তুতকারী সংস্থা মার্লবোরো-র বিপনন। আর তার পরই সারা বিশ্বে ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে ধূমপান-সহ নানা তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবসা আর চাহিদা। এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ সিগারেটের ধোঁয়ায় আসক্ত।
ভারতে ধূমপানের অভ্যেস অতি প্রাচীন। যিশুর জন্মেরও ৩০০০ বছর আগে এ দেশে ধূমপানের প্রমাণ মিলেছে। তবে সে যুগে তামাক পাতায় নয়, গাঁজা গাছের পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়ার নেশা করা হত। তামাক পাতা পুড়িয়ে তার ধোঁয়া টানার কৌশল তার অনেক পরে চালু হয়।
মোঘল চিত্রকলা অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশে ধূমপানের প্রচলন ঘটান মুঘলরা। উপমহাদেশে নবাবি ঘরানার আভিজ্যাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সুগন্ধি তামাক সেবন। পরবর্তী সময়ে হুক্কা ও ছিলিমের সাহায্যেও ধূমপান করা হতো। তামাকের সাহায্যে ধূমপানকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ইউরোপীয়ানরা।
চীনে তামাকের আগমন ঘটে মিং রাজবংশের জিয়াজিং যুগে (১৫২২-১৫৬৬)। দেশটিতে তামাক গিয়েছিল ফিলিপাইন থেকে। সে সময় ফিলিপাইন ছিল স্পেনের উপনিবেশ। স্প্যানিশরাই দেশটিতে তামাক নিয়ে আসে। কয়েক দশকের মধ্যেই চীনের তামাক চাষের পরিমাণ ফিলিপাইনকে ছাড়িয়ে যায়। চীনা তামাক তখন স্প্যানিশ কলোনিতে রপ্তানি হতে থাকে।
অচিরেই চীনে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ধূমপান। এ জনপ্রিয়তার আংশিক কারণ, চীনাদের ধারণা ছিল যে তামাক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। নারী ও শিশুরাও ধূমপান শুরু করে। শরীরে উদ্দীপনা ও আরামের ভাব এনে দেওয়ার পাশাপাশি অনেকেরই বিশ্বাস ছিল, ঠান্ডা ও জ্বরের মতো কিছু রোগ নিরাময় করতে পারে তামাক।
১৭ শতাব্দীর এক চিকিৎসাবিদ্যার বইয়ে তামাক সম্পর্কে লেখা আছে, ‘এই ওষধি উদ্ভিদ দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে।’ তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তামাক ব্যবসা খুব লোভনীয় বাণিজ্য হয়ে ওঠে। ইউরোপে যখন তামাক চাষ শুরু হয়, প্রায় সে সময়ই চীনের শানদং প্রদেশের একটি এলাকায় বিপুল পরিমাণে তামাক চাষ হচ্ছিল। ওই অঞ্চলে ৪০০ শ্রমিক তামাক চাষে নিয়োজিত ছিল। ওই অঞ্চলে তামাক বিক্রি করে বছরে আয় হতো ৭৫ টন রুপা।
কিন রাজবংশের কাংজি যুগের (১৬৬২-১৭২২) বইপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, সে সময় যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা ৬০০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত তামাকের বিনিময়ে একটা ঘোড়া দিয়ে দিত। রাশান সীমান্তরক্ষীরা ছোট তিন-চার থলে চীনা তামাক কিনত একটা ষাঁড়ের বিনিময়ে।
তবে শিগগিরই চীনে তামাক সেবনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাজানি হয়ে যায়। সতেরো শতকের শেষ দিকে লেখা চিকিৎসাবিদ্যা ও উদ্যানবিদ্যার ওপর লেখা কিছু বইয়ে ‘বিষাক্ত গাঁজা’ টানার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, গাঁজা টানলে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে, ফুসফুস জ্বলে যায়। ফলে ধূমপায়ীর গলাব্যথা কাশি হয়— এমনকি কণ্ঠস্বরও নষ্ট হয়ে যায়। ওষুধের নিরাময় ক্ষমতার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে ধূমপান। যারা নিয়মিত ধূমপান করেন, তাদের আয়ুষ্কাল কমে যায়।
চীনে ধূমপানের ওপর প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেন মিং বংশের শেষ শাসক, সম্রাট চংঝেন। ১৬৩৯ সালে, নিজের শাসনকালের দ্বাদশ বছরে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন তিনি। বলা হয়, তিনি শিশুদের একটা ছড়া শুনে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছিলেন। ওই ছড়ায় বলা হয়েছিল, একটা সাম্রাজ্যের ওপর বিদ্রোহীদের ধূমপানের ধোঁয়া গলগল করে উড়ছে।
তারপর কিন রাজবংশ ও পরবর্তী শাসকরা ধূমপান নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। নিষেধ ভঙ্গের শাস্তি ছিল ভয়াবহ। মোটা জরিমানা থেকে শুরু করে চাবুকপেটা, এমনকি শিরশ্ছেদও করা হতো অনেকের। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি করেও চীনে ধূমপান বন্ধ করা যায়নি।
বর্তমানে চীনে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার বিশ শতাংশের বেশি। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বের মোট ধূমপায়ীর এক-তৃতীয়াংশই চীনা। এই বদভ্যাস চীনের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ