ভারত সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের একটি শহরে দেশটির সামরিক বাহিনীর সাথে জান্তাবিরোধী গেরিলাদের ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন ভারত সীমান্তবর্তী থান্টলং শহরের বাসিন্দারা। প্রচণ্ড গোলাগুলির কারণে শহরের বহুসংখ্যক ঘরবাড়িতে আগুন লেগে যায়। এতে শহরে বসবাসকারী ১০ হাজারের বেশি লোক পালিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, একটি এতিমখানার কিছু শিশু আর অভিযানরত সেনা সদস্যরা ছাড়া শহরটিতে আর কেউ নেই। এদের মধ্যে বহু লোক সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। খবর রয়টার্স, ডয়েচে ভেলে।
কিছুদিন ধরে এখানে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনার সংঘর্ষ চলছে। প্রচুর বাড়িতে আগুন জ্বলছে। গত সপ্তাহান্তে অন্তত ২০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
সেনা ও বিদ্রোহীদের লড়াই তীব্র হতেই মানুষ ঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন। স্থানীয় মিডিয়া বুধবার জানিয়েছে, সেনা সাধারণ মানুষের বাড়িতে বোমা ফেলছে। তাই শহরের ১০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে প্রায় সকলেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আশপাশের এলাকায় চলে গেছেন। অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছেন বলে এক স্থানীয় নেতা জানিয়েছেন।
ডয়েচে ভেলের খবরে জানা যায়, নাথিয়াল জেলার ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহে দুই হাজার নয় জন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ভারতে এসেছেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, না পালালে সেনার হাতে মরতে হবে। তাদের কয়েকটি শিবিরে রাখা হয়েছে।
জানা যায়, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় চিন রাজ্যের সীমান্তবর্তী শহর থান্টলং। সেখানে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ থাকতেন। তবে এখন প্রায় জনশূন্য গোটা শহর।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এরপর থেকেই বিক্ষোভ-সহিংসতা লেগে রয়েছে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে।
চলতি সপ্তাহে থান্টলংয়ে সংঘর্ষের সময় অন্তত ২০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, একটি বাড়ির আগুন নেভানোর চেষ্টা করায় এক খ্রিস্টান যাজককে গুলি করে হত্যা করে সেনারা।
তবে সেনাবাহিনীর দাবি, তাদের ওপর শতাধিক ‘সন্ত্রাসী’ আক্রমণ করলে উভয়পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ওই যাজক প্রাণ হারান।
সালাই থাং নামে স্থানীয় এক সম্প্রদায় নেতা জানিয়েছেন, গত কয়েক সপ্তাহে শহরটিতে সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষে অন্তত চার বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন। জান্তাবিরোধী গোষ্ঠী চিন ডিফেন্স ফোর্স জানিয়েছে, তাদের হামলায় অন্তত ৩০ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন।
সালাই থাং অভিযোগ করেন, সামরিক বাহিনী থান্টলং শহরের বাড়িঘরে ঢুকে গুলি চালাতে শুরু করেছিল। এতে মানুষজন পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
সালাই থাং উদ্বাস্তু হওয়া লোকজন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া লোকজন মারাত্মকভাবে খাদ্য ও আশ্রয়ের সংকটে ভুগছে।
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য মিজোরামের একটি নাগরিক সংগঠনের প্রধান জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহে পাশের দেশটি থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
চলতি মাসে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ শুরুর ঘোষণা দেয় দেশটির ছায়া সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুয়া লাসি লা।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের নিয়ে এই সরকার গঠন করা হয়েছে এবং এর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন দুয়া লাসি লা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে। এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে।
চলতি বছরের ১ ফেব্রয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সন সুচিকে হটিয়ে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী এবং এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। অং সান সুচি ও তার দল এনএলডির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা বর্তমানে গৃহবন্দি বা কারাবন্দি অবস্থায় আছেন।
পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’র তথ্য অনুযায়ী, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৫৮ জন নিহত হয়েছেন এবং ৬৩০০-র বেশি মানুষকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ