আফগানিস্তানের নতুন তালিবান সরকার ঘোষণা করেছে শরিয়াহ আইন মেনে বোরখা পরেই মেয়েরা কাজে যোগ দিতে পারবেন। কিন্তু আফগান মেয়েরা অভিনব প্রতিবাদের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, শরীর ঢাকতে বোরখা লাগে না, সাধারণ ঐতিহ্যবাহী পোশাকই যথেষ্ট। তালিবানদের বোরখা পরার ফতোয়ার বিরুদ্ধে তারা শুরু করেছে অনলাইন প্রচার।
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বর্ণিল পোশাক বেছে নিয়েছেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আফগান নারীরা। পাশাপাশি তালিবানকে হুঁশিয়ার করে বলছেন, ‘আমার পোশাকে হাত দিও না’।
নিজ দেশে তালিবান নতুন নিয়ন্ত্রণকর্তার আসনে বসার পর নারীর পোশাক-পরিচ্ছদের উপর যে খড়গ নেমে এসেছে, তারই প্রতিবাদে এভাবে শামিল হচ্ছেন তারা।
আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী বর্ণময় সব পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে তারা হাজির হচ্ছেন সোশাল মিডিয়ায়। ‘ডোন্টটাচমাইক্লথ’ কিংবা ‘আফগানিস্তান কালচার’ হ্যাশট্যাগে ফেইসবুক-টুইটারে চলছে এই প্রতিবাদ।
কট্টর ইসলামী গোষ্ঠী তালিবান দুই দশক পর আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসার পর নারীর স্বাধীনভাবে চলার পথ হয়েছে সঙ্কুচিত।
তার প্রতিবাদে আফগান নারীরা যখন তালিবানের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভে নেমেছে, ঠিক তখনই বিপরীত চিত্রে তালিবানের পক্ষ নিয়ে দুদিন আগে হিজাব-বোরকায় আচ্ছাদিত একদল নারীও কাবুলে সমাবেশ করে।
তাদের সেই সমাবেশ থেকে বলা হয়, ‘মেকআপ নিয়ে আধুনিক পোশাক পরা আফগানিস্তানের মুসলিম নারীদের প্রতিচ্ছবি নয়’ এবং ‘শরিয়াহ আইনের বিরোধী বিদেশি নারী অধিকার আমরা চাই না’।
সেই সমাবেশের পরই আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ও বর্ণিল পোশাক পরে প্রতিবাদের সূত্রপাত বলে বিবিসি জানিয়েছে।
আফগানিস্তানের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বাহার জালালি সোশাল মিডিয়ায় এই প্রতিবাদের সূচনা করেন হ্যাশট্যাগ দুটি ব্যবহার করে।
সবুজ রঙা এক ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে টুইটারে হাজির হন তিনি। অন্যদেরও তিনি অনুপ্রাণিত করেন তাকে অনুসরণ করতে, দেখাতে যে এটাই আফগানিস্তানের ‘প্রকৃত চিত্র’।
এই পথে নামার কারণ ব্যাখ্যা করে বাহার বিবিসিকে বলেন, “আজ আফগানিস্তানের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা হুমকির মুখে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।
“আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, যেটা তারা মিডিয়ায় দেখেছে (তালিবান সমর্থক নারীদের সমাবেশ), সেটা আমাদের সংস্কৃতি নয়, সেটা আমাদের পরিচিতি নয়।”
ড. বাহারের আহ্বান দ্রুতই সাড়া ফেলে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আফগান নারীদের মধ্যে।
বহু জাতি, গোত্রের দেশ আফগানিস্তানে নারীদের পোশাকেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য; সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদী এই নারীদের পোশাকেও সেই বৈচিত্র্য রয়েছে।
কেউ পরেছেন বড় কামিজ, কেউ আবৃত হয়েছেন লেহেঙ্গায়, কারও মাথায় টুপিও রয়েছে; তবে রঙের ক্ষেত্রে রয়েছে ঐক্যের টান। সবারই পোশাকে রয়েছে রঙ-বেরঙের ছটা।
আর তারা সবাই এক বাক্যে বোঝাতে চেয়েছেন, এ্ই পোশাকই তাদের পরিচিতি, এটাই তাদের স্বাতন্ত্র্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় থাকা অধিকারকর্মী স্পোজমে মাসীদ এই আন্দোলনে শামিল হয়ে টুইটারে লিখেছেন, “এটাই আফগান নারীদের সত্যিকারের পোশাক। আফগান নারী এই ধরনের বর্ণিল ও রুচিশীল পোশাকই পরে থাকে। কালো বোরকা কখনই আফগানিস্তানের সংস্কৃতিতে ছিল না।”
মাসীদ লিখেছেন, “যুগ যুগ ধরে আমরা একটি ইসলামী দেশ হিসেবে রয়েছি, তার মধ্যেই আমাদের দাদি-নানীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেই দিন কাটিয়েছিলেন। তারাও কখনও আরবের কালো বোরকা পরেননি।”
“ঐতিহ্যবাহী এসব পোশাক আমাদের হাজার বছরের উন্নত সংস্কৃতিকে মেলে ধরে, যা আমাদের গর্বিত হতে শেখায়, বুঝতে শেখায় আমরা কারা।”
জমকালো লেহেঙ্গা পরে মাথায় টিকলি দিয়ে নিজের ছবি পোস্ট করে মাসীদ লিখেছেন, “কারণ আমি আফগান নারী, আমরা আমাদের পোশাক নিয়ে গর্ব বোধ করি। আর আমাদের পরিচিতি কী হবে, তা কোনো একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ঠিক করে দিতে পারে না।”
তালিবান নেতারা ইতোমধ্যে বলেছেন, মেয়েরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারবে, শরিয়া মোতাবেক কাজও করতে পারবে, তবে ‘ড্রেস কোড’ মানতে হবে।
তালিবান শাসন শুরুর পর হয়রানি এড়াতে রাজধানী কাবুলসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের নীল কিংবা কালো রঙের বোরকা পরেই বের হতে দেখা যাচ্ছে। যে পোশাকে সারা দেহের সঙ্গে মুখও ঢাকা থাকে।
তালিবান প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, আফগান মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনা করার অনুমতি দেয়া হবে যেহেতু দেশটি নিজেকে পুনর্গঠন করতে চায়, কিন্তু লিঙ্গ-বিচ্ছিন্নতা এবং ইসলামিক ড্রেস কোড বাধ্যতামূলক হবে। তালিবান শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা অনুসারে যেখানে সম্ভব মেয়েরা ছাত্রীদের পড়াবে এবং তাদের শ্রেণীকক্ষও আলাদা থাকবে।
প্রাগে থেকে ভার্চুয়াল এই আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাংবাদিক মালালি বশির লিখেছেন, তিনি জন্মভূমি আফগানিস্তানে যে গ্রামে বেড়ে উঠেছেন, সেখানেও নারীরা বোরকা পরত না। এটা সংস্কৃতির অংশই ছিল না। বয়স্কা নারীরা মাথায় কালো রঙের স্কার্ফ পরত, আর মেয়েরা পরত রঙিন স্কার্ফ। আর ছেলে-মেয়েতে দেখা হলে হাত মেলানোর রীতিও ছিল।
নিজের স্মৃতি থেকে আঁকা আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী দলগত নৃত্যের একটি ছবি পোস্ট করেছেন মালালি; তার উদ্দেশ্য, আফগানিস্তানে নারীদের পোশাকের সংস্কৃতি যে আসলে কী, সেটা তুলে ধরা।
নারী অধিকারকর্মী লিমা হালিমা আহমদ লিখেছেন, “আমাদের সংস্কৃতি অন্ধকারময় নয়, এটা সাদা-কালোর মতো বর্ণহীন নয়, বরং রঙিন-উজ্জ্বল। আর এটাই সৌন্দর্য, এটাই শিল্প।”
প্রসঙ্গত, এর আগে পূর্ববর্তী শাসনকালে তালিবানরা আফগান নারীদের বোরকা পরিয়ে পর্দানসীন করে রেখেছিলো। গত ১৫ অগাস্ট ফের কাবুলের মসনদে বসার পর নতুন তালিবান নেতারা সেই নিয়ম ফিরিয়ে এনেছেন। এর প্রতিবাদেই এবার মুখ বন্ধ করে না থেকে নিজেদের মতো করে সোচ্চার হয়েছেন আফগান নারীরা, তাও আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা বিশ্বের সামনে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ