বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নারী যেমন একদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে, অপরদিকে উদ্বেগজনকভাবে নিজেরা শিকার হচ্ছে ‘নির্যাতন’ নামক ভাইরাসের।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী কোনো না কোনো সময় নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এই সংখ্যা লকডাউনের সময় বেড়েছে।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার গবেষক পিটারম্যান ও তার সহলেখকগণ ২০২০ সালে ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলোপমেন্ট থেকে প্রকাশিত ‘মহামারি ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা’ শিরোনামে গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দার সময় নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
যেমন, আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রামণের সময় যৌন নিপীড়ন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ইয়াসমীন (২০১৬) দেখান যে, ইবোলার সময় ধর্ষণসহ নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বেড়ে গয়েছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ভারতে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। দেশটির জাতীয় নারী কমিশনের (এনসিডব্লিউ) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ বছর দেশটিতে নারী নির্যাতনের অভিযোগ গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকাশিত এ পরিসংখ্যানে সবার ওপরে রয়েছে উত্তর প্রদেশ। দ্বিতীয় অবস্থানে দেশটির রাজধানী দিল্লি।
এনসিডব্লিউ’র পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তাদের কাছে নারী নির্যাতন সম্পর্কিত মোট ১৯ হাজার ৯৫৩টি অভিযোগ জমা পড়েছে। গত বছর একই সময়ে এ ধরনের অভিযোগ এসেছিল ১৩ হাজার ৭১৮টি।
চলতি বছর শুধু জুলাই মাসেই ভারতজুড়ে নারী নির্যাতনের ৩ হাজার ২৪৮টি অভিযোগ পেয়েছে এনসিডব্লিউ। ২০১৫ সালের জুনের পর থেকে এক মাসে আর কখনোই এত বেশি নারী নির্যাতনের অভিযোগ পায়নি তারা।
ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশন জানিয়েছে, চলতি বছর সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশে। সেখানে মাত্র আট মাসে নারীদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ জমা পড়েছে ১০ হাজার ৮৪টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দিল্লি। ভারতীয় রাজধানীতে নারী নির্যাতনের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে ২ হাজার ১৪৭টি। এছাড়া হরিয়ানায় অভিযোগের সংখ্যা ৯৯৫ এবং মহারাষ্ট্রে ৯৭৪টি।
চলতি বছর ভারতজুড়ে নারী নির্যাতনের যত অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার অর্ধেকের বেশিই উত্তর প্রদেশের। এগুলোর বেশিরভাগই নারীদের সম্মানহানি, ঘরোয়া অশান্তি ও যৌতুকের দাবিতে বিবাহিত নারীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা। এছাড়া, নারীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ১১৬টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ ১ হাজার ২২টি এবং সাইবার অপরাধের অভিযোগ ৫৮৫টি।
এদিকে, ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
অবশ্য এনসিডব্লিউর চেয়ারপারসন রেখা শর্মা মনে করছেন, ভারতে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়া। এখন নারীরা নির্যাতনের ঘটনা চেপে না রেখে অভিযোগ জানাতে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, গত বছর জানুয়ারি থেকে আগস্টের তুলনায় চলতি বছর এই আট মাসে দেশজুড়ে নারীদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে জাতীয় মহিলা কমিশন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী নির্যাতন ভাইরাসে আক্রান্ত সমাজকে রোগমুক্ত করার জন্য চাই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রথমত, করোনার সময় ও এর পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে এই সময়ে উন্নত অনেক দেশের মত নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জরুরি হটলাইন সেবা প্রদান করা।
নারী যেন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায়ও তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট করতে পারে সে বিষয়ে স্থানীয় থানার পুলিশ সদস্যদের আরো তৎপর হতে হবে। এখন থেকেই নারী নির্যাতনের হট-স্পট হিসাবে পরিচিত অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করতে হবে যেন করোনা পরবর্তী সময়ে ঐ অঞ্চলগুলোতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৫৭
আপনার মতামত জানানঃ