করোনার মধ্যে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। গত দেড় বছরে পারিবারিক সহিংসতার পাশাপাশি ৭০ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাই নারী কর্তৃক ঘটেছে। এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের চেয়ারম্যান ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। আজ শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকাতেই দিনে ৩৮টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতি মাসে ৯৯টি বিচ্ছেদ বেড়েছে। মহামারির মতো সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা। অর্থনৈতিক কারণে অশান্তিতেও ভাঙন ধরেছে অনেক সংসারে।
লিগ্যাল এইডের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরে সমৃদ্ধ হলাম যে, করোনায় গত দেড় বছরে কী ধরনের পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যতার কারণে মানুষের দারিদ্রতা বেড়েছে। আয় কমেছে, এজন্য পারিবারিক সহিংসতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দেড় বছরে যৌতুকসহ পারিবারিক সহিংসতা এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ের বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনার মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। জাতীয় লিগ্যাল এইড এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে।
জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় ভাঙছে একটি সংসার। এক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছেন নারীরা, ৩০ শতাংশ দিচ্ছেন পুরুষরা। তবে এটা কেবল শহরের হিসাব। করোনার ধাক্কায় আয় সংকুচিত হয়েছে বহু মানুষের। তবে সংকটকালের এই অভিঘাত এখানেই থেমে নেই।
ঢাকার দুই সিটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৪ হাজার ৫৬৫টি বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে, অর্থাৎ প্রতি মাসে ১ হাজার ১৪১টি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২। এই হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে বেড়েছে ৯৯টি বিচ্ছেদ। গত বছরও নারীদের তরফে ডিভোর্স বেশি দেওয়া হয়েছে, যা ৭০ শতাংশ।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিক্ষিত নারীদের নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে এখনও প্রস্তুত নন ছেলেরা। তারা শিক্ষিত মেয়েকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান কিন্তু শিক্ষিত মেয়ের চাকরি জীবন, তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, তাকে সাংসারিক বিষয়ে সহযোগিতা করা—এসবে পূর্ণ স্বাধীনতা বা সহযোগিতা করতে নারাজ স্বামীরা। ফলে একটি শিক্ষিত মেয়ের যখন আত্মসম্মানে আঘাত আসে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের। যেহেতু সমঝোতা কেবল নারীকেই করতে হয়, তাই মেয়েটি বেছে নেন একলা জীবন। করোনায় অর্থনৈতিক সংকট, মানসিক ও সামাজিক চাপের কারণে কলহ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে।
শিক্ষিত নারীদের নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে এখনও প্রস্তুত নন ছেলেরা। তারা শিক্ষিত মেয়েকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান কিন্তু শিক্ষিত মেয়ের চাকরি জীবন, তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, তাকে সাংসারিক বিষয়ে সহযোগিতা করা—এসবে পূর্ণ স্বাধীনতা বা সহযোগিতা করতে নারাজ স্বামীরা। ফলে একটি শিক্ষিত মেয়ের যখন আত্মসম্মানে আঘাত আসে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের।
এদিকে শিক্ষিত ছেলে হলেও তার সঠিক সামাজিকীকরণের অভাবে তিনি গতানুগতিক পুরোনো সংসারের ধ্যান-ধারণা লালন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিও চান, তাদের মা-চাচি বা দাদি-নানিরা যেভাবে শ্বশুরবাড়ির এবং স্বামীর সব সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে সংসারে টিকে থাকতেন, ঠিক তেমনিভাবে এ প্রজন্মের মেয়েটির একইরকম হোক। কিন্তু বর্তমান সমাজের শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীর পক্ষে সেই বউ হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। এতে শুরু হয় সংসারে অশান্তি। ফলে অন্যের বাড়িতে চাপের মুখে কিংবা গুমট পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেন বিবাহবিচ্ছেদের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। মহামারিকালে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন। গত বছর রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৮১টি আবেদন করেছিলেন নারী, বাকি ৪ হাজার ৩২টি বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন পুরুষ।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দপ্তরে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত করা হয়। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে দুই পক্ষ আপস অথবা প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বেশির ভাগ তালাক দিচ্ছেন নারীরা। দুই সিটিতেই ৭০ শতাংশ তালাক নারীরা দিচ্ছেন। করোনার মধ্যে পারিবারিক বোঝাপড়া নিয়েই মূলত তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে। পাশাপাশি নারীরা এখন বেশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাই তালাকের পর কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না।
বছর দুয়েক আগে ডিভোর্স নেওয়া শায়লা (ছদ্মনাম) তার বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছিল একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। পরিবারের সবাই শিক্ষিত। শায়লা নিজেও একটি কলেজের শিক্ষক। বিয়ের তিন দিনের মাথায় তার শিক্ষিত শ্বশুর শায়লাকে ডেকে বলেন, ‘তুমি যতই শিক্ষিত হও, মনে রাখবে, এ সংসারের বউ তুমি। সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দেবে, এত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা এ বাড়িতে চলবে না। এ কথা শুনে ঘরে এলে শায়লার স্বামী বলেন, তোমার আরো আগেই ঘুম থেকে ওঠা উচিত ছিল, বাবা তো ঠিকই বলেছেন।’ এর একদিন পর শায়লা বাপের বাড়ি এসে নিজেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। তিনি জানান, একজন শিক্ষিত মেয়ের ন্যূনতম সম্মান দেওয়া হয়নি ঐ বাসায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরে ডিভোর্সের মধ্যে নারীরা এগিয়ে থাকলেও সেটা সারা দেশের চিত্র নয়। নিম্নবিত্তের বিয়ে বা ডিভোর্সের কোনো তথ্য নথিভুক্ত সব সময় হয় না। তবে নিম্নবিত্তের মধ্যে স্বামীরাই ডিভোর্স দিচ্ছে বেশি। সেখানে মেয়েটি সংসার টিকিয়ে রাখতে অনেক কিছু সয়ে গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা টিকছে না এবং অনেক ক্ষেত্রে বিয়েটা ঝুলে থাকে।
একাধিক জরিপ ও সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাকালে নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক নারী বিবাহবিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৭১ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছেন।
আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা অনেক বেড়েছে। আগে প্রান্তিক নারীরা জানতেন না যে তারা তালাক দিতে পারেন। তাই তারা মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করতেন। পাশাপাশি একটা ভুল ধারণা ছিল যে, ডিভোর্স দিলে নারীরা মোহরানার টাকা পাবেন না। এখন এটা বেশির ভাগ নারীই জানেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ডিভোর্সেও রেট বাড়ছে। শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না, অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বউকে চাকরি করতে দিয়েছি, কেউ বলছে আমার বউমার চাকরি করার দরকার নেই’—তার মানে মেয়েটি স্বামী বা শাশুড়ির সিদ্ধান্তে চলছে। তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকছে না। আবার প্রায় শুনতে হয়, আপা আমার স্বামী আমাকে সন্দেহ করে, ট্যুরে গেলে সন্দেহ করে’—এটা মেয়েটির জন্যে একটা সাইক্লোজিক্যাল ট্রমা। একজন নারী যত শিক্ষিতই হোক, তার বুদ্ধি কম, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই—এমনটা ভাবা হয়। একটা ছেলেকে বড় করতে যে সামাজিকীকরণ, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা বদলাতে হবে। সমাজ, রাষ্ট্র, উপাসনালয়—সব জায়গায় নারীকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পত্তিতে সমান অধিকার—এই বিষয়গুলোর পরিবর্তন করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৬৪৬
আপনার মতামত জানানঃ