প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১১শ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত বহুল আলোচিত ই-অরেঞ্জের (ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান) অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও নেপথ্যের পরিচালক পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানার জ্ঞাতআয়বহির্ভূত বিস্তর সম্পদের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। নামে-বেনামে থাকা তার সম্পদের মধ্যে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ৫টি ফ্ল্যাট, ৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাণিজ্যিক ভবনে জায়গা (স্পেস), ২টি প্লট ও ৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আরও চারটি দেশে তার সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি ই-অরেঞ্জে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসার পরপরই সোহেলের অর্থ-সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে একাধিক সংস্থা। বনানী থানার ওই পুলিশ কর্মকর্তার অর্থবিত্তের খোঁজ নিচ্ছে এমন একটি সূত্র থেকে গতকাল রোববার এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা বেহাত হওয়ার তথ্য মিলেছে। এই অর্থ ই-অরেঞ্জ থেকে সরিয়ে দেশে-বিদেশে অন্যান্য ব্যবসায় সোহেল বিনিয়োগ করেছেন— এমনটি বলছেন সংশ্নিষ্টরা।
ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের মামলায় আসামি হওয়ার পরপরই দেশ থেকে পালাতে গিয়ে শুক্রবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চ্যাংড়াবান্ধা এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে আটক হন সোহেল। বিনা ভিসায় ভারতে প্রবেশের দায়ে করা মামলায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বর্তমানে তিনি তিন দিনের হেফাজতে রয়েছেন। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময় সোহেলের কাছ থেকে থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি ডেবিট কার্ড জব্দ করা হয়। তার পাসপোর্টে ভারতের ভিসা না থাকলেও ছিল থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, চীন ও শেনজেন ভিসা।
শেখ সোহেল রানা বছর চারেক আগে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হন। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন গুলশান ও বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। তার এত বিপুল সম্পদের কথা শুনে পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিস্মিত। পুলিশ সূত্র জানায়, সোহেল রানার অর্থসম্পদের খোঁজে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এদিকে, সোহেলকে ভারতে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বনানী থানায় তার পদে নতুন কর্মকর্তা হিসেবে উত্তরা-পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর গাজীকে বদলি করা হয়েছে।
জানা যায়, শেখ সোহেল রানা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই থাকাকালে কূটনৈতিক অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
গুলশানের পর সোহেল রানা ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হলেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসবিতে ছিলেন। এরপর চার মাস কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমে ছিলেন। গত বছরের ২৮ মে থেকে বনানী থানায় পরিদর্শকের (তদন্ত) দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
ই-অরেঞ্জের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলা দুটি তদন্ত করছেন গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম। গতকাল তিনি জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরদিন তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালান। তিনি বলেন, সোহেল রানার অর্থসম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ তার দেশে-বিদেশে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ফ্ল্যাটের তথ্য পেয়েছে। এখন আদালতের মাধ্যমে সোহেল রানার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হবে।
এখন পর্যন্ত সোহেল রানার যেসব সম্পদ থাকার তথ্য মিলছে তার মধ্যে রয়েছে পূর্বাচলে ৩ নম্বর সেক্টরে প্লট ও নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট। একটি ফ্ল্যাটে তার ছোট খালু মো. সাগর থাকেন। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তার বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন তিনি। তার অফিস গুলশান ২ নম্বরে ডিসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারের পেছনে। এ ছাড়া গুলশানের শাহজাদপুরে আছে তার তিনটি ফ্ল্যাট। খাগড়াছড়িতে একটি রিসোর্টের জন্য জায়গা কেনা রয়েছে সোহেলের। গোপালগঞ্জে প্রায় ৫০০ বিঘার বেশি জমির মালিক তিনি। গুলশান এলাকায় ব্যবসা করছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ আছে তার। তিনি আমেরিকান, জার্মান ও কোরিয়ান ক্লাবের সদস্য।
নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। নামে-বেনামে থাকা তার সম্পদের মধ্যে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ৫টি ফ্ল্যাট, ৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাণিজ্যিক ভবনে জায়গা (স্পেস), ২টি প্লট ও ৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আরও চারটি দেশে তার সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিদেশে সোহেল রানার সম্পদের মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ডের পাতায়ায় জমি, ফ্ল্যাট ও সুপারশপ। সেখানে হিলটন হোটেলের পাশে আরেকটি পাঁচতারকা হোটেলে শতকোটি টাকার বিনিয়োগ, পর্তুগালে দোকান ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, প্যারিসে রেস্টুরেন্ট ও বার ব্যবসা, ফিলিপাইনের ম্যানিলায় স্ট্রিট বার এবং নেপালেও নানা ব্যবসায় তার বিনিয়োগ আছে। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ই-অরেঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া অর্থের একটি বড় অংশ থাইল্যান্ডে পাচার হয়েছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল সর্বশেষ শাহজাদপুরের সুবাস্ত নজরভ্যালির টাওয়ার-৩- এর ফ্ল্যাট ১০/বি-এ বসবাস করতেন। এখন পর্যন্ত কাগজপত্রে তার চারটি বিয়ে করার তথ্য পাওয়া যায়। তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ১০ বছর ধরে সম্পর্ক নেই। তার দ্বিতীয় স্ত্রী একজন অভিনেত্রী। লন্ডনে পড়তে গিয়ে তৃতীয় বিয়ে করেন সোহেল। চতুর্থ স্ত্রীর নাম নাজনীন নাহার বীথি। তিনি ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের মামলার আসামি হিসেবে বর্তমানে পলাতক।
এ ছাড়া সোহেলের ছোট বোন সানিয়া মেহজাবিন জুঁই ই-অরেঞ্জের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। তার স্বামী মুসফিকুর রহমান সুমন অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ডিজিএম। তবে দীর্ঘদিন ধরে ছোট বোন মেহজাবিনকে সামনে রেখেই নেপথ্যে থেকে ই-অরেঞ্জ পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি।
চতুর এই পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে পুলিশে যোগ দেন। ছাত্রাবস্থায় ক্যাম্পাসে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তিনি। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পুলিশ থেকে চাকরি হারান সোহেল। এর পরই আবার চাকরি ফেরত পান। দীর্ঘদিন ঘুরেফিরে গুলশানে নানা পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গুলশান-বনানীকেন্দ্রিক অবৈধ ভিওআইপি কারবার, স্পা সেন্টার, হোটেল-বার ও বিভিন্ন দূতাবাস থেকে ভিসা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আইনের রক্ষক হয়ে যখন একজন পুলিশ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, একজন অপরাধীর চেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে সম্পূর্ণই এর বিপরীত। অপরাধ জগতের ডন হয়েও শাস্তি পায় সাময়িক বরখাস্ত ও পুলিশ লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া।
তারা বলেন, সাম্প্রতিককালে পুলিশের এহেন অপকর্মের অভিযোগ সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি পরিমাণে আসছে। পুলিশের কাছে অনেকটাই জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, কর্মজীবীরা। কিছু হলেই সন্ত্রাসীদের চেয়ে ভয়ানক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হয়। যখন তখন ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লুটে যাচ্ছে প্রচুর টাকা। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পুলিশবাহিনীর আমূল পরিবর্তন দরকার। এ বাহিনীতে বর্তমানে কমিটমেন্ট ও রিসোর্সের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসে। কিন্তু সব অভিযোগই যে সত্য এটা সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে অর্ধলক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিন বিভাগে। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি নিশ্চিত করাই হলো অপরাধ দমনের প্রথম পদক্ষেপ। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞরা জানান, পুলিশের মতো একটি বড় বাহিনীতে নানা ধরনের ও মানসিকতার লোক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে কেউ কেউ দুর্নীতি ও অপকর্ম করবে বা করার চেষ্টা করবে, তা-ও স্বাভাবিক। এটা মোকাবিলার পথ হচ্ছে শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে সদস্যদের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া, যথাযথ তদন্ত করা এবং কেউ কোনো ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাহিনী হিসেবে পুলিশকে যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার নাগরিকের জন্য যে চরম ভীতিকর ও হয়রানিমূলক হতে পারে, তা মাঝেমধ্যে আমরা টের পাই।
তারা বলেন, বোঝা যায় তদারকি কর্মকর্তাদের শৈথিল্যের কারণে এই পুলিশ কর্মকর্তা এত কিছু করতে পেরেছে। একটাই প্রশ্ন, যারা তদারকি করবেন, তাদেরও তো দায়ভার থাকা উচিত। এটা না হলে তা চলতেই থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ