গত আগস্ট মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে নারী মৃতের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর মূল কারণ টিকা না নেওয়া, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন না হওয়া এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার। সূত্র মতে, ১২ আগস্ট প্রথমবারের মতো নারী মৃতের সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে যায়।
শুরু থেকে পুরুষের তুলনায় নারী আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম হলেও দৈনিক মৃত্যুর খাতায় চলতি বছর ১ মার্চ নারী ও পুরুষের মৃতের সংখ্যা সমান দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মূলত মার্চ মাস থেকেই নারী মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
মূলত দেশে করোনার ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে মৃত্যুর ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা দেয়। শুরু থেকে ষাটোর্ধ্ব মানুষের মৃত্যু বেশি ছিল। এখনো বেশি মৃত্যু হচ্ছে ষাটোর্ধ্বদের। তবে জুন থেকে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের মৃত্যু বাড়তে দেখা যাচ্ছে। একইভাবে নারীর মৃত্যুও এ সময়ে এসে আগের চেয়ে বেড়ে যায়। তবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে করোনার ডেল্টা ধরনের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো গবেষণা নেই। যদিও জনস্বাস্থ্যবিদদের অনেকে মনে করেন, ডেল্টা ধরনের কারণে এসব পরিবর্তন এসেছে।
গত ১২ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১০৮ জন নারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর পুরুষ মৃতের সংখ্যা ছিল ১০৭। শেষবারের মতো নারীর মৃতের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি দেখা যায় ৩০ আগস্ট। উক্ত তারিখে মোট ৯৪ জন মৃতের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ৪৯, যেখানে পুরুষ ছিল ৪৫।
এর এক দিন আগে পরপর দুই দিন নারী মৃতের সংখ্যা বেশি ছিল। ২৯ আগস্ট নারী মৃতের সংখ্যা ছিল ৪৮, যেখানে পুরুষ ছিল ৪১। আর ২৮ আগস্ট নারীর মৃতের সংখ্যা ছিল ৬১, যেখানে পুরুষ ছিল ৫৬।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে প্রথম করোনায় মৃত্যু হয়। ঐ মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। এক বছর পরে ২০২১ সালের মার্চে এসে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪১৬। এ সময় নারীর মৃত্যুর হার ছিল ২৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর পুরুষ মৃত্যুর হার ছিল ৭৬ দশমিক ৬১ শতাংশ।
পাঁচ মাস পরে আগস্টে শেষে এসে দেখা যায় নারী মৃত্যুর হার বেড়ে ৩৫ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং পুরুষ মৃত্যুর হার কমে ৬৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়। এর আগে জুলাইয়ে নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে ২৯ শতাংশে উঠে যায়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তা ৩৩ শতাংশ ছাড়ায়। মহামারির এক বছরে নারী মৃত্যুর হার ছিল পুরুষের অর্ধেকেরও অনেক কম।
যেকারণে বাড়ছে নারী মৃত্যুর হার
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস পরিচালক ও এইচআইএস এবং ই হেল্থ লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, নারীরা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তুলনামূলক সচেতন কম। তারা বাড়ির কেউ আক্রান্ত হলে তাদের সেবা করার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। আবার নিজেদের রক্ষা করার জন্য টিকাও নেন না।
পর্যবেক্ষণে করে দেখা গেছে, নারী মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার জন্য ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মূল কারণ টিকা না নেওয়া। আবার এখন নারীরা বেশি বাইরে বের হচ্ছেন।
গত ১২ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময় ১ হাজার ২৮৬ জন নারী ও ১ হাজার ৪২৫ জন পুরুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মোট সংখ্যার হিসেবে নারীর মৃত্যু কম হলেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের পর অগাস্ট মাসেই লাফিয়ে বাড়ে নারী মৃত্যুর হার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করে মোট ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার ৮৩৯। আর নারী ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯০৩ জন। ঐদিন পর্যন্ত ৫৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৪২ দশমিক ৫৬ শতাংশ নারী প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করেন।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ মনে করেন, অনেকগুলো কারণেই নারীর করোনায় মৃত্যু বেড়েছে। নারীরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছে বলেই বেশি মারা যাচ্ছে। নারীরা এখন ঘরের বাইরে বেশি আসছে। শনাক্তকরণে অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেশি। আবার ডেল্টার পরিবর্তিত ধরন হরমোনের কারণেই নারী ও শিশু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
আর টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কম থাকা এর একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, নারীর নিজের প্রয়োজনে নিজে আগ্রহী হলে ভালো, আর তা না হলে সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে নারীকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
এদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কাওসার আফসানা বলছেন নারীদের মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়ে যাওয়ার মূলে ব্যাপক গতিতে ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।
“বয়ষ্ক নারীদের মধ্যে টিকা দেয়ার প্রবণতা এখনো কম। আবার বাড়ীতে কেউ অসুস্থ হলে নারীরাই তাদের যত্ন এবং দেখা-শোনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এসব কারণে তারা এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “পারিবারিক ও সামাজিক কিছু সংস্কৃতিও নারীদের জন্য ঝুঁকির পরিবেশ তৈরি করছে। যেমন ধরুন বাইরে থেকে বাজার করে আনলে এখনো বহু পরিবারে গৃহকর্ত্রীই সেগুলো আগে দেখে থাকেন। আবার বাইরে থেকেও অনেকে বয়স্কদের দেখতে আসে। এই করোনার সময় বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আসার পর এসব বিষয়গুলো নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে।”
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১৪
আপনার মতামত জানানঃ