মেয়েদের শিক্ষার বিস্তারে বাধা এলেও থেমে থাকবেন না তারা। জীবন দিয়ে হলেও সেই কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে। তালিবানকে এ বার কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন সে দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলি।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক ফতোয়া জারি করতে শুরু করেছে তালিবান। নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে এবং মেয়েরা পড়তে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও একই ব্যবস্থা করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে তালিবান।
এর বিপরীতে এবার রুখে দাঁড়াচ্ছে দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকেরা। তারা বলছেন, “যে ভাবে একের পর এক তালিবানের নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া শিক্ষাব্যবস্থার উপর নামতে শুরু করেছে, তাতে মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারে চলমান প্রচেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হবে।”
তারা আরও বলেন, “তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে সমস্ত অধিকার হারানোর ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছি। যদিও তারা আশ্বাস দিয়েছে স্কুলে যেতে বাধা দেওয়া হবে না, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হবে না। কিন্তু সেই ভরসা অনেকেই রাখতে পারছেন না।”
জানা যায়, যদি তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাদের যদি শিক্ষা বিস্তারের কাজে বাধা দেওয়া হয়, তা হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। তালিবানের চোখে চোখ রেখে নিজেদের অটুট সঙ্কল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তাতে যদি মরতেও হয় তার জন্যও রাজি আছেন শিক্ষকরা।
অন্য দিকে, ফতোয়া জারি করলেও তালিবান কিন্তু নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই বার বারই তারা নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছে। শিক্ষিত আফগান মানুষদের দেশ ছেড়ে না পালানোর পরামর্শ দিচ্ছে। তবে এই সমস্ত কিছুই মূলত শুকনো কথায় চিড়ে ভিজানোর মতো।
মূলত আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও স্বীকৃতির জন্যই তালিবান ভান ধরছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তাই তাদের সেই আশ্বাসে আর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না বহু আফগান। ১৯৯৬-এ তালিবান রাজের ভয়ানক অভিজ্ঞতাই যেন দেশ ছেড়ে পালানোয় উৎসাহ জোগাচ্ছে।
এদিকে, তালিবান দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগঠনটির নানা কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গত সপ্তাহে কাবুল দখলের পর তালিবান সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১৫ বছরের বেশি মেয়েদের বিয়ে করার জন্য তুলে আনছে বলে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা হলি ম্যাককি নামে এক সাংবাদিক দ্য ডালাস মর্নিংকে জানান।
তালিবান কাবুল দখলের আগে সেখানকার এক আশ্রয় কেন্দ্রে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল হলির। হলি দ্য ডালাস মর্নিংকে বলেন, ফারিহাকে তার বাইরের দেশের বন্ধুরা বারবার আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু নিজ দেশের মেয়েদের বিপদে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন ফারিহা।
হলি জানান, ফারিহা আমাকে বলেছিল তালিবান বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের বিয়ে করার জন্য খুঁজছে। কয়েকমাস আগেই বাদাখশানের পতন হয়েছিল। এক মাস আগে বাদাখশানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল তালিবান। সেখানে গিয়ে তালিবান বিয়ের জন্য কিশোরী মেয়েদের খুঁজছিল।
হলি জানান, তালিবান এক বাবার কাছে গিয়ে তার মেয়েকে বিয়ে করতে চান। ২১ বছর বয়সী মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া হয় এক তালিবান সদস্যের সাথে। বিয়ের পর মেয়েটিকে নিয়ে যায় তারা।
হলি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, ১৪ আগস্ট রাতে মাজার-ই-শরিফ পতনের পর রাতারাতি তা নারী শূন্য ভূতুড়ে নগরীতের পরিণত হয়। দিনের বেলায় অল্প কয়েকজন নারীদের নীল বোরকায় আবৃত হয়ে বাইরে বের হতে দেখেছেন তিনি।
এর মাঝেই জীবনশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন আফগানিস্তানের নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা। তাদের এখন যৌনদাসী করা হতে পারে, এমনকি তালিবানদের নির্যাতনে মৃত্যুও হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
এদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশলেটও বলেছেন, নারীদের প্রতি তালিবানের আচরণ এখনো ‘রেড লাইন’-এ রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তালিবানদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘প্রতিক্রিয়াশীল নীতি বাদ দিয়ে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিন।
এই কথায় কান নেই তালিবানের। উল্টো নিরাপত্তার অজুহাতে নারীদের বাসায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান। তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, নারীদের নিরাপত্তা এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় সাময়িকভাবে তাদের ঘরে থাকতে হবে।
তবে জাবিউল্লাহ মুজাহিদকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানিয়েছে, নারীদের কর্মস্থলে যোগদানে স্থায়ীভাবে বাধা দেওয়া হবে না। তারা যাতে কাজে ফিরতে পারেন, সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। যদিও তালিবানের এই আশ্বাসে বিশ্বাস রাখছেন না আফগান নারীরা।
তাদের ধারণা মূলত তালিবান নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সময় এবং রসদ যোগানোর জন্যই এইসব আশ্বাসের বাণী শোনাচ্ছে। দেশে তালিবান ছাড়া নিরাপত্তার কোনও হুমকি নেই। সেখানে কীসের নিরাপত্তার অজুহাতে তালিবান নারীদের ঘরে বন্দি করছে, তার উত্তর কারও জানা নেই।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে তালিবান নারীদের স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি বাইরে বের হওয়ার সময় নারীদের চেহারা দেখানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শরিয়াহ আইনের নামে তালিবান মূলত নিজেদের আদর্শের প্রচার চালিয়ে আসছে। আফগানিস্তানে এই উগ্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর উত্থানে আবারও দেশটির উন্নয়নের সমস্ত পথই বন্ধ হবার মুখে। পশ্চিমাদের নীরব সমর্থন আর পাশ্ববর্তী দেশগুলোর স্বার্থান্বেষী বৈদেশিক নীতিই মূলত আফগানিস্তানকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। আর একই সাথে দেশটির সাধারণ মানুষের সামাজিক ও মানবিক সব অধিকারকে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ছড়ানো এই গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৫৮
আপনার মতামত জানানঃ