কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান তালিবানের দখলে চলে গেলেও আফগানিস্তানের পঞ্জশির প্রদেশটি এখনও তালিবানের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গতকাল সোমবার (২৩ আগস্ট) পঞ্জশির প্রদেশে তালিবানরা কয়েকশ যোদ্ধা পাঠিয়েছে। তারা প্রদেশটি ঘিরে ফেলেছে। এমনকি আন্দারব উপত্যকায় খাবার ও জ্বালানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে খাদ্য সংকটে পড়েছে প্রদেশটি। তালিবানের ভয়ে হাজার হাজার নারী শিশুকে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
এদিকো জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে— ঝুঁকিতে থাকা মানুষের কাছে জরুরি খাদ্য সহায়তা পাঠাতে না পারলে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের খাদে পড়বেন আফগানরা। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা ও মানবিক সংকটের আশঙ্কা করছেন।
এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা শান্তিপূর্ণভাবে তালিবানের হাতে নিয়ন্ত্রণ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর পঞ্জশিরে তালেবান যোদ্ধাদের পাঠানো হয়।
তালিবানবিরোধী নেতা আমরুল্লাহ সালেহ টুইট করে লিখেছেন— আন্দারব উপত্যকায় খাবার এবং জ্বালানি আসতে দিচ্ছে না তালিবান। সেখানে লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হাজার হাজার নারী ও শিশু পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রয়াত তালিবানবিরোধী নেতা আহমদ শাহ মাসউদের ছেলে আহমদ মাসুউদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবও দিয়েছে তালিবান। তবে তার সঙ্গে আলোচনা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এমতাবস্থায় পঞ্জশিরে জারি রয়েছে প্রতিরোধ। তালিবান বাহিনী খাবার ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
এভাবে তালিবানকে মেনে না নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে পঞ্জশিরের সাধারণ মানুষকে। সংঘাতের ভয়ে সেখানকার নারী-শিশুরা পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। গত দুদিন ধরে তালিবানরা শিশু ও বৃদ্ধদের অপহরণ করে তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। এভাবেই তারা বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছেন।
আফগানে খাদ্যসংকটের সতর্কবার্তা জাতিসংঘের
তালিবানের হাতে আফগানিস্তানের পতনের পর দেশটিতে আগে থেকেই বিদ্যমান খাদ্য সংকট আরও গভীরতর হচ্ছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ঝুঁকিতে থাকা মানুষের কাছে জরুরি খাদ্য সহায়তা পাঠাতে না পারলে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের খাদে পড়বেন আফগানরা। খবর বিবিসির।
জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, তালিবানের সঙ্গে সমঝোতা করে মাত্র একটি প্রদেশে খাদ্য সহায়তা বিতরণ করতে সমর্থ হয়েছে তারা। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) পরিসংখ্যান বলছে, আফগানিস্তানের তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে এক কোটি ৪০ লাখই খাদ্য সংকটে ভুগছেন।
করোনা ভাইরাস মহামারী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং দুর্যোগ খরার কারণে খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে কাবুল পতনের পর টানা আট দিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় মানবিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে চারদিকে খাদ্যের হাহাকার বাড়ছে।
একজন আফগান টুইটারে লিখেছেন, ‘তিন শিশু নিয়ে আমরা খাদ্য সংকটে রয়েছি। আজ চা দিয়ে রুটি খেয়েছি। কাবুলে গ্যাসের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত, সব ব্যাংক বন্ধ, খাবারের দোকানে লোক নেই, মোবাইলে রিচার্জ করা যাচ্ছে না। আমরা জীবন নিয়ে শঙ্কিত।’
ডব্লিউএফপির হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে মানুষের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং প্রায় ২০ লাখ শিশুর পুষ্টিবিষয়ক বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন।
মানবিক সংকট ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের
তালিবানদের ক্ষমতা দখলের ঘটনায় কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা ও মানবিক সংকটের আশঙ্কা করছেন। এর প্রভাব সমগ্র অঞ্চলে পড়তে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। আফগানিস্তানের তালিবান শাসন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জঙ্গিদের অনুপ্রাণিত করবে বলেও তারা মনে করছেন।
অপরদিকে, খনিজ পদার্থে ভরপুর দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলো কৌশলগত কারণে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতায় নামবে। তবে, তা নির্ভর করবে কীভাবে তালিবানরা নিজেদেরকে উপস্থাপন করছে তার ওপর।
তারা চাইলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। কিংবা আগ্রাসী হয়ে কঠিন পন্থা অবলম্বন করে তাদের গতবারের শাসনামলের মত (১৯৯৬-২০০১) শরিয়া আইন চালু করতে পারে। আল-কায়েদা ও আইএআইএসের সঙ্গে তারা যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পালিয়ে যাওয়ার পর তালিবানরা মোটামুটি বিনা বাঁধায় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকে তালিবান ও আফগান নেতারা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা করছেন। দেশটির সরকারের কাঠামো এখন কেমন হবে সেটিও পরিষ্কার নয়।
তালিবানরা তাদের আগের শাসনামলে হত্যা ও ব্যভিচারের দায়ে প্রকাশ্যে ফাঁসি এবং চুরির দায়ে অভিযুক্তদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার মত শাস্তির প্রচলন করেছিল। পুরুষদের দাড়ি রাখা ও মহিলাদের সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখার উপযোগী বোরখা পরা আবশ্যক ছিল। নারীদের স্কুলে যাওয়া ও কাজ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তালিবানরা টেলিভিশন, সঙ্গীত ও সিনেমা নিষিদ্ধ করেছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের অভিযোগ এসেছিল।
এখন তারা নিজেদেরকে একটি মধ্যপন্থী সংগঠন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। তারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ও আইএস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারপরেও তালিবান শাসনের ভয়ে হাজারো আফগান নাগরিক নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রক্রিয়ায় দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে পালিয়ে যাচ্ছেন।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালিবানরা আফগান নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ করা ছাড়াও, ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় এবং তালিবানদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘আফগানিস্তান দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে আছে’।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ